জসিম মল্লিক
লেখক পরিচিতিঃজন্ম বরিশাল শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু এবং দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক-এ নিয়মিত লিখছেন। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতার শুরু। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতা ও লেখালেখির অভিজ্ঞতা।এ পর্যন্ত তার প্রায় পঁয়ত্রিশটির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
ছয়টার মধ্যেই ঘুম ভাঙ্গে আমার। আজকে একবার ঘুম ভেঙ্গে দেখি চারটা বাজে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ঢক ঢক করে পানি খাই। ওয়াশরুমে যাই। জেসমিনের ঘরের দরজার দিকে উঁকি দেই। মুদৃ নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে। আহা জীবন কত বদলে গেছে! ৃদুটি পাখী একটি ছোট্ট নীরে কেউতো কারো পানে চায় না ফিরেৃটাইপ জীবন। কালকে অৰ্কৱ সাথে ভিডিওতে কথা বলেছি। আহা বাছাকে দেখিনা ঢাকা থেকে আসার পর।
আবার ঘুমিয়ে ছয়টাৱ মধ্যে উঠে যাই। জানালাৱ পৰ্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই। অন্ধকার বাইরেটা। কোনো জনমানুষ্যি নাই।অন্য সময় হলে অনেকেই এই সময়ে কাজে যায়, গাড়ির চলাচল থাকে। ওজু করে নামাজ পড়ি। নামাজে বসে মনোযোগ হারাই বারবার। মনে মনে বলি এতো ছোট্ট একটা জিনিস, অনু পরমানুর চেয়েও ক্ষুদ্র এক চীজ সেটার ভয়ে মানুষ আজ দিশেহারা। কুকড়ে আছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। কে কখন আক্রান্ত হবে জানা নাই। অনেক চেনা মানুষের মত্যুর খবর শুনতে পাই। তখন নিজের বানানো চা বিস্বাদ লাগে।
রাতে স্বপ্নে দেখলাম কৱোনার ভয়ে ব্যাংকক চলে যেতে চাচ্ছি।মনে মনে বলছি ওখানে কি নিরাপদ! কোথায় নিরাপত্তা! কোথাওতো নিরাপত্তা নাই। আবার স্বপ্নে দেখলাম আমি আর জেসমিন সিডনি গেছি। যে বাসায় উঠেছি সেখানে অনেক লোকজন দেখে আমি হোটেল খুঁজছি। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, হোটেল কতদূর! সে বলল ধারে কাছে কোনো হোটেল নাই। যেটাওবা আছে সেটা অনেক দামী হোটেল। একবারতো ভুল বাসায় ঢুকে পরেছি। বাসার লোকটা খুব জেরা কলল আমাকে। তারপর কি হলো আর জানি না..। আবার দেখি একটা কবিতা উৎসবে গেছি। সেখানে পরিচিত মানুষরা হৈ হল্লা করছে খুউব..।
এইসব এলেবেলে ভাবনা রাতের ঘুম নষ্ট করে দিয়েছে। ফেসবুক খুলতে ভয় পাই।টেলিভিশনের পৰ্দায় বা সংবাপত্রের পাতায় চাখে বুলাতে ইচ্ছা করে না। শুধু নেগেটিভ খবর। ইউরোপ আমেরিকায় মত্যুর মিছিল। কানাডায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মুত্যুর সংখ্যাও। আগামী দুই সপ্তাহ খারাপ হবে আরো বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ সেই তুলনায় ভাল আছে। সেখানে জনসংখ্যা অনুয়ায়ী আক্রান্ত এবং মত্যুর সংখ্যা নগন্য। এটা মনে আশা জাগায়।
মানুষও বসে নেই। বিজ্ঞানীরা করোনাকে জয় করবেই একদিন।মনে মনে ভাবি কাল সকালেই শুনব করোনা নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। করোনা যেমন মানুষের কাছে ছিল অচিন্তিনীয় তেমনি যদি কাল সকালে শুনি আর করোনা নাই, আক্রান্ত বা মৃত্যুর ঘটনা নাই সেটা মোটেও বিস্ময়ের হবে না। পৃথিবীতে কত মিরাকলইতো ঘটে। যিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনিই ভাল জাানেনৃ। আমি আশাবাদী মানুষ।
আল্লাহ তুমি সবাইকে ভাল রাখ। সবাই নিরাপদ থাক, ঘরে থাক।
টরন্টো ৩১ মার্চ ২০২০
টরন্টো আসার পর ছেলে মেয়ের কাছে যাওয়া হয়নি। ছুঁয়ে দেখা হয়নি।তারাও আসেনি কেউ। আসতে মানা। আমাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎকন্ঠায় ছিল অৰ্ক। প্রতিদিন ম্যাসেজ পাঠাত বাবা চলে আসো, যেভাবে পারো চলে আসো। সেই অৰ্কর সাথে আমার ভিডিওতে কথা হয়। অরিত্রি একদিন বাসার নিচে পৰ্যন্ত এসেছিল। সব পরিবারের জীবনে নেমে এসেছে এমন এক অবস্থা। সোশ্যাল ডিসটান্সিং। এটাই নিরাপদ পন্থা। সবারই এটা মানা উচিত। পৃথিবী এতোবড় সঙ্কটে পড়েনি আগে। তাই অভ্যস্ত হতে সময় লাগছে। সবার আৰ্থ সামাজিক অবস্থাও এক না। খেটে খাওয়া মানুষদের বেশিদিন আইসোলেশনে থাকা সম্ভব হবে না। আশাকরি ততদিনে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আশা নিয়ে বসে থাকি।
সময় যেনো অনড় পাথর। কোনো কিছুই করতে ইচ্ছে করে না। বই পড়তে না, লিখতে না।এমনকি খবরও দেখি না। ওসব দেখে মন ভারাক্রান্ত করতে ইচ্ছা করে না। শুধু মুভি দেখি আর গান শুনি। ফোনেও কথা হয় না তেমন কারো সাথে। ফোনালাপে আমি ভাল না।বোরিং। আমার কথা আসে না তেমন। কিন্তু সবার জন্য ফীল করি। মনে মনে ভালবাসা দেই। শুধু প্রতিদিন সকালে এগারোটার দিকে জাস্টিন ট্রুডোর ব্রিফীং শুনি। যেনো ওটার জন্যই আমি অপেক্ষা করি।
এবার ঢাকা গিয়ে আমার ছেলে মেয়ের কিছু পুরনো ছবির এলবাম খুঁজে পেয়েছি। একসময় আমি ওদের অনেক ছবি তুলতাম। আমার একটা পেনটাক্স কে১০০০ ক্যামেরা ছিল। একটা না দুটো ছিল। সেইসব ছবি প্রিন্ট করতাম গুলশান এক এ ফুজি কালারের একটা ল্যাব ছিল সেখান থেক। কাজটা যথেষ্ট ব্যায়বহুল ছিল তা সত্বেও কিভাবে তারা বেড়ে উঠছে সেইসব ধারাবাহিক ছবি তুলে এলবামে সাজাতাম আমি।
অৰ্ক অরিত্রিকে ফোন করি মাঝে মাঝে। দিনের বেলা ব্যস্ত থাকে অফিসের কাজে। অরিত্রি করোনা কাল আসার আগেও সপ্তাহে দু’তিন দিন ঘরে বসেই অফিস করত। এমনকি এবার যে ঢাকা গেলো এক সপ্তাহের জন্য সেখানেও রাত জেগে কাজ করেছে। টরন্টোতে যখন দিন ঢাকায় তখন রাত।আমাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিল বাবা, ওয়াইফাই যেনো থাকে। কালকে অরিত্রিকে ফোন দিলাম, তখন বেলা তিনটা…
আম্মু কি করো।
এইতো লাঞ্চ ব্রেক ছিল।
খেয়েছো!
হ্যাঁ।
কি খেলা আম্মু!
একটু ম্লান কন্ঠে বলল, পাস্তা খেয়েছি।
কালকেও জেসমিনের কাছে শুনেছি পাস্তা খেয়েছে। মনে মনে বলি, আজও!
মজা হয়েছে!
অরিত্রি হেসে বলল, হ্যাঁ।
তাও ভাল এই সুযোগে অরিত্রি রান্নাটা শিখে ফেলছে।
সাতটার দিকে অৰ্ককে ফোন দিলাম..
কি করো আব্বু।
এই তো বাবা, ডিনার করব, প্রিপারেশন চলছে।
খাতিজা কি করে।
ও চিকেন রান্না করছে। তারপর অৰ্ক বলল, আজকে মিষ্টি বানালাম বাবা, রসগোল্লা তোমাকে ছবি পাঠাচ্ছি।
ওহ গ্রেট। ঠিক আছে। সাবধান থাক। বাইরে যেওনা দরকার ছাড়া।
চলবে…