জসিম মল্লিক
লেখক পরিচিতিঃজন্ম বরিশাল শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু এবং দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক-এ নিয়মিত লিখছেন। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতার শুরু। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতা ও লেখালেখির অভিজ্ঞতা।এ পর্যন্ত তার প্রায় পঁয়ত্রিশটির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
টরন্টো ১ এপ্রিল ২০২০
মুভি দেখতে দেখতে হঠাৎ আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম কাল।মুভি চলছে, আমি টিভির দিকে তাকিয়ে আছি কিন্তু দেখছি না। কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করছি আনমনে। এমনকি মুভির নাম পর্যন্ত জানি না। টিভি অফ করে দিলাম। নিজের মনোযোগ অন্যদিকে ডাইভার্ট করার উপায় খুঁজছি। হাতের কাছেই ফোন। সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করলাম। কেনো যেনো ফোনটাকেও হঠাৎ একটা আপদ মনে হতে লাগল। নেগেটিভ বার্তা বহনকারী। ওয়াইফাই এবং ফোনের ডাটা দুটোই অফ করে দিলাম। এই যন্ত্রটাকে আমরা জীবনের অনিবার্য অংশ করে তুলেছি। যেনো এটা না থাকলে জীবন বৃথা হয়ে যাবে। যখন সেল ফোন ছিল না তখনওতো জীবন চলেছে। আমি একসময় প্রচুর চিঠি লিখতাম। পত্রলেখক হিসাবে আমার একটা সুখ্যাতি ছিল। অনেক পেনফ্রেন্ড ছিল। সেইসব চিঠি ডাকবিভাগের মাধ্যমে আদান প্রদান হতো। আজকের দিনের মতো ম্যাসেঞ্জার, হোয়টসএপ বা অন্য মাধ্যমে দ্রুত লিখে, দ্রুত উত্তর পাওয়ার যে আনন্দ সেটা সম্ভব ছিল না কিন্তু অপেক্ষারও একটা আনন্দ ছিল।
পৃথিবীতে কিছুই অনিবার্য না। টিভিও না, ফোনও না, সংবাদপত্রও না।সবকিছু জানতে হবে, বুঝতে হবে, দেখতে হবে এমন কোনো কথা নাই। অনেক কিছু না জেনে না বুঝেও জীবন চলে যাবে। জীবনের প্রতিকুলতা আর দুঃসময়কে যত সহজভাবে গ্রহন করা যায় ততই ভাল। মৃত্যু নিয়ে এতো আদিখ্যেতারইবা কি আছে। অসুখে বিসুখে, মহামারিতে না হয় সাধারণ মুত্যু হবে। মৃত্যুকে কেউ রোধ করতে পারবে না। আগে অথবা পরে দরজায় এসে কড়া নাড়বে। তা নিয়ে এতো ভেবে কি হবে। মৃত্যু একটি মহান ঘুম এর বেশি কিছু না। নিজের মনোযোগ সারাক্ষণ একটি জায়গায় নিবিষ্ট হওয়ার কারণে একটা ভীতি, একটা প্রচন্ড মানসিক চাপ তৈরী হয়েছে। সেই চাপ থেকে মুক্ত থাকার জন্যই টিভি, খবরের কাগজ, ফোন, ট্যাবলেট এসব গ্যাজেটস থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে চাচ্ছি। অন্য কিছুর প্রতি মনোযোগী হতে চাই। কোরান পাঠ তার মধ্যে অন্যতম হতে পারে। কিংবা প্রিয় বইগুলো পড়া যেতে পারে। কাল সারাদিন পড়েছি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস মায়াবতী এবং তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে। এই সব হালকা টাইপ উপন্যাস মনকে প্রফুল্ল রাখে।
লেখালেখিও করা যেতে পারে এই সুযোগে।সেজন্য লেখক হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখুন। নিজের আনন্দ বেদনার স্মৃতিগুলো লিখে রাখুন। ভাল সময়ে সেইসব স্মৃতি বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারবেন। যে বইগুলো এখনও অপঠিত রয়ে গেছে সেগুলো পড়ুন। অথবা পছন্দের বই বারবার পড়ুন। কবিতা আবৃতি করুন নতুবা গান শুনুন। সন্তানদের সাথে আরো নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলন। পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবহিত করুন, সাহস দিন। স্ত্রীকে ঘরের কাজে সাহায্য করুন। কৃচ্ছতা সাধন করুন। সামনে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সমূহ সম্ভবনা আছে। কোটি কোাটি মানুষ চাকুরি হারা হয়েছে। বিত্তবানরা গরীবের পাশে দাঁড়ান, তাদের সাধ্যমতো সাহয্য করুন। এখনই সময়।
যারা এই দুঃসময়ে জীবন বাজী রেখে মানুষের সেবা করছেন সেইসব ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, আর্মী, সরকারী কর্মকর্তা, সমাজসেবী, এনজিও, রাজনৈতিক কর্মী সহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি সহমর্মী হোন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। একসময় এই বিপর্যয় কেটে যাবে। সবকিছু আবার সুন্দর হবে। এক সুন্দর পৃথিবীর অপেক্ষায় মানুষ। যদি বেঁচে থাকি তাহলে এবার ফিরে আসব নিজের শিঁকড়ের কাছে। নিজের জন্মস্থানেই যেনো হয় আমার কবর। নিজের মা বাবার পাশে। আজ সারাদিন এই কথাগুলোই ভেবেছি। কেনো ভেবেছি তা জানি না। বরিশালের ছায়াঘেরা, শ্যামল সুন্দর, ঘুঘু আর ঝিঁঝি ডাকা শব্দের মধ্যেই যেনো হয় আমার মরন। আমি আর কিছুই চাই না, খ্যাতি চাই না, সম্পদ চাই না, নাগরিক উপভোগ চাই না, আমি শুধু ফিরতে চাই। এবার ফেরাও মোরে..।
চলবে…