জসিম মল্লিক
লেখক পরিচিতিঃজন্ম বরিশাল শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু এবং দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক-এ নিয়মিত লিখছেন। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতার শুরু। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতা ও লেখালেখির অভিজ্ঞতা।এ পর্যন্ত তার প্রায় পঁয়ত্রিশটির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
আমার মা কোনোদিন প্লেনে চড়ে নাই। মায়ের সবচেয়ে দূরের জার্নি ছিল বরিশাল থেকে ঢাকা। তাও এক দু’বার আমার বাসায়। আমি যে এতো দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াই মা খুউব অবাক হতো। একদিন বলল, তুমি একটা পাখী এই দেখি, এই দেখি নাই। আসলেই বরিশাল ছাড়ার পর আমি একটানা মায়ের কাছে বেশীদিন থাকিনি। আমার মায়ের খুব বেশি চাহিদা ছিল না। চাহিদা তৈরীই হয়নি। সংসারের কাজ করতে করতেই মা জেরবার। চাওয়া পাওয়ার কথা ভুলেই গেছিল। মা কোনোদিন সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখেনি, রেষ্ট্যুরেন্টে বসে খায়নি, লং ড্রাইভে যাইনি, কোনোদিন উপন্যাস পড়েনি, নিউজ পেপাড় পড়েনি। রঙিন পাড়ের শাড়ি বা গহনা পরতে দেখিনি, ঠোঁটে লিপস্টিক দেয়নি বা মেকআপ করেনি। তবুও মা ছিল অপরূপ সুন্দর। শুধু মায়ের বৈধব্যের বেশ ছিল আমার অপছন্দ। আমি রঙিন শাড়ি বা গহনা কিনে দিতাম মাকে।
বলতাম পড়তে হবে মা! একদিন মা আমাকে চুপি চুপি বলল, তুমি যে আমারে কানের দুল কিনে দিছ সেটা তোমার যখন বউ হবে তারে দিব বুজছ!আমি মায়ের কথা শুনে হাসি। মজা করে বলি, মা আমাকে কোনো মেয়ে বিয়েই করবে না।
মাও হাসে, বলে করবে।রেডিও অন করে কিভাবে গান শুনতে হয় মা জানত না। চেষ্টাও করেনি। টিভির রিমোটও কখনও হাতে ধরেনি। ছোট বেলায় দেখতাম যখন রেডিওতে বা টিভিতে গান বাজত মা কখনও কখনও থমকে দাঁড়াত। হয়ত কোনো একটা গানের কোনো লাইন মায়ের ভাল লাগত। মা খুউব নিভৃতচারী মানুষ ছিল।
একদিন আমাকে বলল, তুমি এতো কি লেখো! তোমার কাছে এতো চিঠি কারা লেখে! তুমি যখন ঢাকা থাকো তখনও মেয়েরা আসে বাড়িতে। একদিন একটা মেয়ে এসেছিল আমাকে দেখতে। বলেছে তোমার লেখা পড়ে। তাকে পেয়ারা খেতে দিছি। ওই রকম সুন্দর একটা বউ আনব তোমার জন্য। এই কথা বলে মা ফিক করে হাসে। একদিন মা বলল, ওই গানটা আমাকে আবার শোনাবা! আমি বললাম কোন গানটা। মা বলল ওই যে ’তুমি কি দেখেছো কভু।’ আমি ক্যাসেট চালিয়ে মাকে গানটা শোনাই। বারবার।.. তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়…। মার চোখ ভিজে জল আসে..!
টরন্টো ১০ মে ২০২০