সেজান মাহমুদ
লেখক পরিচিতি: কথাশিল্পী, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার, পেশায় চিকিৎসা বিজ্ঞানী। ইউনিভার্সিটি অব সেন্টার ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনে সহকারী ডিন ও প্রফেসর হিসাবে কর্মরত।
“বিদেশের কুকুর ধরি স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া” ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের এই কবিতা বাঙালির প্রবাদে পরিণত হয়েছে বিষয়ের সত্যতার জন্যে। সামাজিক মাধ্যম থেকে শুরু করে নানান প্রতিষ্ঠানের আচরণ থেকেও বুঝতে পারবেন এই প্রবণতা কোন মাত্রায়। এখানে আগেই বলে রাখি, জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার জন্যে যে কারো কাছে, তা দেশি বা বিদেশি হোক হাত পাতুন। আমি সেই প্রবণতার কথা বলছি না; বলছি উদ্দেশ্যমূলকভাবে যখন নিজেদের পাণ্ডিত্য বা বিশেষজ্ঞতা থাকা স্বত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে বিদেশের দ্বারস্থ হ’য়ে নিজেরদের লোকদের হেয় করতে চেষ্টা করা হয়, সেই প্রবণতার কথা বলছি।
বাংলাদেশের নানান স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠান প্রায়ই, ইন্ডিয়া থেকে বিশেষজ্ঞ এনে বক্তৃতা দেয়া শুরু করেছে। শুধু তাই না, প্রচুর ইন্ডিয়ান ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এর পেছনে আয়োজকদের দুটো ধান্দা থাকে; এক, ব্যবসা। কারণ, জনগণের কাছে বিদেশি বললে আস্থা বেশি। অন্যটি যদি কোন ইন্ডিয়ান ট্রেইনিং নিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়।
অন্যদিকে যে কথাগুলো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কোন বিজ্ঞানী বা গবেষক বলছেন, যা হয়তো অন্য বিদেশিরা শুনে ধন্য হয়, বাংলাদেশের লোকেরা ইন্ডিয়া থেকে ধার কথা কাউকে দিয়ে সেই কথাগুলোকেই পূনঃপ্রচার করছে বেশি গুরুত্ব দিয়ে। এই পদ্ধতিকে বলা হোয় “ডাইলুশন” -মানে হলো কারো কথা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, তাহলে একই রকম অন্য কারো কথা এনে ডাইলিউট করে দাও, বা ঘনত্ব কমিয়ে দাও (বাংলাদেশের পত্রিকা-কেন্দ্রিক লেখকেরা অন্য লেখকদের নিয়েও এটা করেন, ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে)।
আমরা যারা বিভিন্ন দেশে কাজ করি, তাঁরা জানি এটা অনেক সময় আমেরিকায় বা ইউরোপে বা অন্য ধনী দেশের শাদারা ক’রে থাকে অন্য কালারড ইমিগ্রান্টদের নিয়ে। যেমন, একজন অধস্থন ভাল কোন আইডিয়া নিয়ে এলো, উর্ধতন শাদা লোকটি হয়তো তা লুঠে নিয়ে এমনভাবে প্রেজেন্ট করবে যেন ওটা তাঁর নিজের আইডিয়া ছিল।
আমি ব্যক্তিগতভাবে করোনা নিয়ে নিচের কয়েকটি কথা, বড় বড় প্রতিষ্ঠান, বড় বড় চিকিৎসক বা এমনকি কিছু বড় বড় নেতাদেরও আগে থেকেই বলে আসছিঃ
এক। কোভিড ১৯ প্রতিরোধের প্রস্তুতির কথা, টেস্ট ক্যাপাসিটি, পিপিই বিশেষ করে ডাক্তারদের জন্যে এয়ারবর্ণের মতো মনে করা ( জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) মাসেই বলেছি)
দুই। প্রতিরক্ষার জন্যে নিজের ইমুউনিটি ঠিক রাখার উপায় (দশটি পদ্ধতি বা কাজ, মার্চ বা তার আগেই বলেছি) )
তিন। বাংলাদেশে যা রোগী বা ইনফেকশন রেট তা আন্ডারবিপোর্ট (মানে সংখ্যায় অনেক বেশি হবে, -ফেরুয়ারি মার্চ-এপ্রিলে বলেছি)
চার। লক ডাউন বা সামাজিক শারীরিক দূরত্ব ঠিক রাখার সঙ্গে ইনফকশেনের সম্পর্ক সরাসরি যুক্ত। টেস্টিং ম্যাস আকারে করা, মডেলিং করা)
পাঁচ। যে কোন ওষুধ কিছুসংখ্যক রোগী কে ভাল করা মানেই কার্যকরী না (এটা আমেরিকায় প্রাক্টিসিং ডাক্তারদের কেও বলেছি)
ছয়। কোভিড ১৯ একটি পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্যের বিষয়। ক্লিনিক্যাল দিক দরকার মাত্র ৫%-১৫% লোকের জন্যে, কিন্তু ৮৫% মানুষের জন্যে জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা ছাড়া উপায় নেই। এমনকি চিকিৎসার সিদ্ধান্তও জনস্বাস্থ্যের গবেষণাভিত্তিক।
সাত। আপনি রোগী দেখছেন জন্যেই আপনি চিকিৎসার সব জানেন ভাবার কোন কারণ নেই, নতুন চিকিৎসায় এভিডেন্স কীভাবে তৈরি হয়, বিচার হয়, তার পদ্ধতি না-জেনে আপনিও ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন।
এই কথাগুলো আবার মনে করিয়ে দিলাম, কারণ, বহু ডাক্তারকে দেখেছি সেই মার্চ মাসের দিকে বলতে যে এরা (আমরা যারা আগাম প্রস্তুতির কথা বলেছি) তাঁরা প্যানিক ছড়ায়। এখন বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের সংখ্যা দেখুন। অন্যদিকে গতকাল আইইডিসিআর থেকে স্বীকার করছেন যে আক্রান্তদের সংখ্যা যা পজিটিভ তাঁর ৩০-৪০ গুণ। অথচ আমাদের মিডিয়া কাদেরকে পাবলিক স্পিকিং -এ হাইলাইট করছে? লক্ষ্য করে দেখুন কয়ভাগ ইন্ডিয়ান ডাক্তারের কোটেশন আর কতোভাগ বাঙালি। অথচ দেশ বিদেশে বাঙালি অনেক ডাক্তার বা বিজ্ঞানী আছেন যারা বিশ্বমানের চিকিৎসা ও গবেষণায় সাফল্য এনেছেন।
হ্যাঁ, কোভিড ১৯ বা ইবোলা বা এরকম ইমার্জিং গ্লোবাল ডিজিজে আমরা অনেকেই বিশ্বের মানুষদের নির্দেশনা দিতে পারি। ইবোলা মহামারীর সময়, আমেরিকার সকল বড় প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে গিয়ে আমিই বলেছিলাম এয়ারপোর্ট থেকে স্ক্রিনিং শুরু করতে (এখনও নিউজে তা পাবেন) যা পরে সরকারিভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। এগুলো নিজেকে জাহির করার জন্যে বলছি না; বলছি একারণে যে আমাদের “বিদেশের কুকুর ধরি স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া” মনোভাব না বদলালে চিরকাল এই হীনমন্যতা নিয়েই বেচে থাকতে হবে। আর হীনমন্য মানুষ কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। আসুন এই সংকট থেকে শিখে আমরা একযোগে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই।