জাহানারা বুলা,ঢাকা।
মাসের পর মাসও আমি ঘরে থাকতে পারি। ঘরে থাকাই আমার অভ্যাস। তবে, ঘরটা হতে হবে থাকার উপযুক্ত – পরিচ্ছন্ন এবং পরিপাটি। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ কি না তা আমি জানি না। তবে, এটা যে আমার জীবনের অংশ সেটুকু জানি।
গত ছাব্বিশ বছর হয় আমার বাসায় একটি মেয়ে কাজ করে। ছ’মাস বয়সের একটি শিশু পুত্র নিয়ে আমার ঘরের দরজায় এসে বলেছিলো- আমার বাচ্চাটা কানলে উপরের সাহেব খুব রাগ করে। খালাম্মা, এইটুক বাচ্চার কান্নাকি আমি থামাই রাখতে পারমু? আমি ওর কথার কোনো উত্তর না করে শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম- আমার বাসায় কাজ করবি? আমারও তোর বাচ্চার সমান বাচ্চা আছে। তাই, তোর বাচ্চা কাঁদলে আমি বোকবো না। ঠিক সেদিন থেকে চম্পা ওর ছেলে রাসেলকে নিয়ে আমার বাসায়।চম্পা রান্না নিয়েই ব্যস্ত থাকতো, এখনো তাইই। ওর সহযোগী ছিলো আরো দুজন। একজন চম্পার কাজে সাহায্য করে বাকি সময় ঘরের কাজ করতো। তৃতীয় মেয়েটি আমার ছেলের খেয়াল রাখতো।
বরাবরই তিন জন কাজের লোক ছিলো আমার। এখন দুজন দিয়েই খুব ভালো চলে যায়। সংসারের ঝামেলা কমেছে, কমেছে ব্যস্ততাও। কারণ, ছেলে -মেয়ে দুজনই বড় এখন। তার মধ্যে মেয়ে চলে গেছে কানাডায় বেশ কয়েক বছর আগেই। আমার ছেলে, মেয়ের সাথেই চম্পার ছেলে বড় হয়েছে। আর্ট শেখা, কোরান পড়া, কম্পিউটার শেখা, সবই ওরা একই সাথে শিখেছে। রাসেল কিছুদিন আগে বিবিএ পাস করেছে। আমাদের অফিসেই কাজ করেছে।
২০১৩ তে যখন ছেলেকে নিয়ে আমি কানাডায় গেলাম ওর পড়ার জন্য, তখন চম্পা একাই থাকে ওর ছেলে সহ আমার বাসায়। রাসেলকেও ধরতে গেলে আমিই কোলে পিঠে করে বড় করেছি, নিজের ছেলের মত করেই। রাসেল যখন এস এসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন, হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে গেলো ও। শুরু হোলো ডাক্তারের কাছে দৌড়ানো। ধরা পড়লো লিম্ফোমা- গ্ল্যান্ড ক্যান্সার। এপোলো হাসপাতলের অংকলজিস্ট ডাক্তাররা মোয়াররফ হোসেনের আন্ডারে শুরু হোলো ক্যামো থ্যারাপি। ভীষণ অসুস্থ তখন রাসেল। তবুও, এস এসসি পরীক্ষা দিলো সে। যদিও একটা সাবজেক্ট রিপিড করতে হয়েছিলো। অবশ্য তাতে ওর বছর নষ্ট হয়নি। এইচ এসসির পাশা পাশিই পাস করে গেল রাসেল।
এর পর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দিয়ে অফিসে জয়েন করিয়ে দিলাম রাসেলকে।আমি তখন কানাডায়। কানাডার কর্ম্মূখর জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছি কেবল। তাই, চম্পা যখন বললো- খালাম্মা, রাসেল অহন চাকরি করলে তো পড়ালেখা নষ্ট ওবো। আমি বল্লাম, কিছুই নষ্ট হবে না। তুই তোর কাজ কর, আমাকে আমার কাজ করতে দে। বিবিএ শেষ করার পর চাকরির বাজারে ঘুরতে হয়নি আর রাসেলের। পড়া চাকরি দুটোই হোলো। কিছু দিন আগে, মানে বছর খানেক আগে বিয়েও হোলো। রাসেলের বউ ইংলিসে অনার্স। এখন মাস্টার্স করছে। রাসেল বিয়ে করবে বলেই ওরা বাড্ডাতে একটি বাসা ভাড়া নিলো। এখন ওরা নিজের বাসায়ই থাকে।
চম্পা সকালে এসে সন্ধ্যা বা বিকেলে যায়, নির্ভর করে রান্নার চাপের উপর। পাশাপাশি ছুটা বুয়া ঘরদোর পরিষ্কার রাখে। কিন্তু, লকডাউনে আমাদের এপার্টমেন্টে বেশ কড়াকড়ি ব্যাবস্থা। বাইরে থেকে রোজ এসে কোনো লোক বা বুয়া কাজ করতে পারবে না। আমি পড়লাম মহা বিপদে। দুই বুয়ার কাজের সব ভার এই বয়সে আমার কাঁধে। তাই, কর্মব্যস্ততা আমার প্রচুর। তার মধ্যে লিখালিখি। লিখাটা যখন টানে তখন কাজ করতে রীতিমতো কান্না চলে আসে।
যাই হোক, কানাডার প্রায় সাত বছরের কর্মমুখর জীবন লক ডাউনে কাজে লাগছে। কাজ যতটাই করি না কেন, সাহসের সাথে করে ফেলি। ছেলে, স্বামীও সাহায্য করছে। কিন্তু, সংসারের কাজতো ফুরোয় না মোটেই। রান্না করলে ঘর দেখতে পারি না, ঘর দেখলে টয়লেট পরিষ্কার করতে পারি না। তার উপর রোজার মাস। এখন ঈদটাও এসে গেলো। কিছুও যদি না করি, অন্তত ঈদের রান্নাটা তো করতে হবে। কেউ নাই আসুক, এক মাস রোজা রাখার পর স্বামী আর ছেলেকে ছোটমোটো একটা ঈদতো উপহার দিতেই হবে।
ওদের দিক থেকে জোরাজুরি না থাকলেও আমার তো মন চায়। তাই, গত কাল থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছি ঈদের রান্নার। এবার ঈদে আড়ম্বর নাও যদি থাকে তবু তৃপ্তি আছে। একটা অহংবোধ কাজ করছে নিজের পারঙ্গমতার জন্য।ঈদ শপিং আমি কোনো কালেই করি না। তাই, এই লকডাউনে শপিং হোলো না বলে কোনো আক্ষেপ নেই আমার। আল্লাহ পাক এখনও সুস্থ রেখেছেন এই অনেক। এর পর কোনো বিলাসিতাই বড় নয়। আমি পরিপূর্ণ আমাদের এই লক ডাউন ঈদ নিয়ে। কষ্ট একটাই- ভাইবোনগুলোর আগমনী উষ্ণতাটুকু এবার পাবো না। তবুও, আল্লাহ মহান! এই অব্দি আমাদের ভালো তো রেখেছেন তিনি। পরম করুণাময় আল্লাহ পাকের কাছে আমার অফুরন্ত শুকরিয়া যে, এবারের ঈদটা তিনি আমার সমস্ত পরিবার এবং দেশবাসীকে উপহার দিলেন। আমি আশাবাদী আগামী ঈদ নিয়েও। তখন ইনশাআল্লাহ সারা পৃথিবীময় ঈদের আনন্দ ঝলমল করবে বলেই আমার বিশ্বাস।