জাহাঙ্গীর নাকির
এবারের ঈদে ঘরে থাকার সুবাদে শাটলট্রেন দেখার সুযোগ হয়েছে। অনলাইনে এই ব্যবস্থা না থাকলে দেখা হত কিনা জানিনা। সিনেমা হলে যাই না তাও ২৫-৩০ বছর তো হবেই। ধন্যবাদ জানাই স্নেহের প্রদীপ এবং ছবির সকল কলাকুশলীকে। এমন ছবি উপহার দেয়ার জন্য।ছবিটি দেখলাম অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মত। এভাবে সম্পুর্ন ছবি আজকাল দেখা হয়না।
পরিচালক নতুন হলেও তার পান্ডিত্য আর মুন্সিয়ানায় ছবিটি হয়ে উঠেছে প্রানবন্ত। বেমানান শুনালেও মনে হচ্ছিল ঋত্বিক ঘটক, মৃনাল সেন, সত্যজিৎ রায়ের চলচিত্র দেখছি। ছবির চিত্রায়নে অনেকটা সেরকম ছাপ রেখেছেন। যতই দেখছি আর ততই ডুবে গেছি আর অনেকটা হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিতে। মনে পড়ে গেল একের পর এক কত ঘটনা। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এখানে সেখানে। আমি মুলত সমাজতত্ত্ব বিভাগের ২২ ব্যাচ। ছবির মধ্য দিয়ে মনে করিয়ে দিল আমাদের সেই পুরানো দিনগুলিকে নতুন করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িয়ে আছে কতশত ঘটনাপ্রবাহ। শুনেছিলাম এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা মুলতঃ অন্যত্র ছিল কিন্তু রাজনীতির ঘেরাজালে পাহাড়ি পরিবেশে নিয়ে আনা হয়। শহর থেকে দুরে এবং ক্যাম্পাসে সবার জন্য আবাসন সুবিধা না থাকায় বহু ক্ষেদ ছিল অনেকের। তবু আজ মনে হয় ভালই হয়েছে। প্রান প্রাচুর্যে ভরপুর নিসর্গিক এমনটা কোথাও তেমন দেখা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের যোগাযোগ ছিল এই শাটলট্রেন। ছবির নামকরণের সার্থকতা এখানেই।
চবি আর শাটলট্রেন মিলেমিশে একাকার।আমাদের সময়ের ক্লাস করা, রাজনীতি, আড্ডা, রোমান্টিকতা আর সংস্কৃতির চর্চা ছিল উল্লেখযোগ্য। তার কিছু অংশ উঠে এসেছে ছবিতে। মনে হচ্ছিল নিজেকেই যেন আবিস্কার করছি ছবিতে সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়ানোর অজস্র স্মৃতি সাথে নিয়ে। কোন একসময় অপরাজনীতির শিকার হয়ে অনেকেরই প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে শহরে গিয়ে থাকতে হয়েছে। ফলে যাতায়াত ছিল এই শাটলট্রেন। ট্রেনের সাথে সবার কমবেশি স্মৃতি জড়িয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আছে সহস্র প্রেম বিরহ বেদনাগাথা। শাটলট্রেনের গানগুলি ছিল প্রানের উচ্ছাস। সবাই যেন এক একজন শিল্পী। এই ট্রেনের সাথে কতশত সংস্কৃতি্র গল্প আর রাজনীতির অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে আছে। ট্রেন ছাড়ার আগে যার যার দল স্টেশনে এসে রাজনীতি সংস্কৃতি আর প্রেমের পাঠ নিত। সত্যি এই মধুর স্মৃতি ভুলতে পারব না। সেটা আবার প্রদীপের দল শাটল্ট্রেনের মাধ্যমে আমাদের ফ্লাশব্যাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।
ছবির প্রতিটি গান নির্বাচন ছিল অপুর্ব। চিত্রায়ন অসাধারণ। গণঅর্থায়নে এমন চলচিত্র আমি এর আগে দেখিনি। একবারে নতুন মুখ নিয়ে এত জনপ্রিয় হতে পারে কোন ছবি ধারনাই ছিল না। তবে চিত্রায়নে কিছু বিষয় কেন বাদ পড়ল সেটা চিত্রনাট্য যিনি করেছেন তিনি ভাল বলতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রথিতযশা শিক্ষক ছিলেন। পদার্থ বিজ্ঞানের জামাল স্যার বেচে থাকলে হয়ত নোবেল আনতে পারতেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী সেন স্যার। ফজলে হোসেন, আনিসুজ্জামান স্যার আলাউদ্দিন আল আজাদ স্যার সহ অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব এখানে শিক্ষকতা করেছেন। যা পরের প্রজন্মের জন্য জানা থাকুক।
‘৭০-‘৮০ দশকের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রগতিশীল চিন্তার ধারক বাহকদের হাতে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছিল এখানে অবিস্মরণীয় ভুমিকা। ছিল জারুলতলার রাজনৈতিক সমাবেশ। ফ্যাকাল্টি ভবনে মিছিল। চাকসু ভবনে রাজনৈতিক আড্ডা। বোটানিক্যাল গার্ডেন, ফরেস্ট বিভাগের নিসর্গ, শহীদমিনার, কাটা পাহাড়ের রাস্তা, নিকুঞ্জ বন আরো কতকি! কাটা পাহাড়ের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বেদনার কাহিনী আছে। এক এক্সিডেন্টে অনেক ছাত্র মারা যায়। ভিসি বাংলো পাহাড়। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির শুনশান নিরবতা, স্টেডিয়াম সব মিলিয়ে অনেক স্মৃতি যা এই পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। ছবিতে আরো প্রানবন্তভাবে হলের জীবন, কটেজ জীবন তুলে আনা যেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ন্যাক্কারজনক অনেক ঘটনা ছিল যা আমাদের মনকে আজো বিষিয়ে তুলে।চট্টগ্রাম রাজনৈতিক ইতিহাসের কিছু আংশিক ইস্যু এসেছে তবে আরো বিস্তারিত ভাবে কেন তুলে আনা হয়নি সেটা সংশ্লিষ্টদের ভাল জানা। রাজনৈতিক ক্ষমতার হাত বদলের শিকার বারবার হয়েছে এখানে। হয়েছে শিক্ষক ছাত্র নির্যাতন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে অসংখ্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের অনেক সুসম্পর্ক ছিল। তাদের ব্যক্তিগত জীবনের কিছুটা তুলে আনা যেত।অনেক ছাত্র জীবন দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান আরো ভালভাবে তুলে ধরা যেত। বিভিন্ন সময়ের ছাত্র নেতাদের ভুমিকা সহ জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন এমন ছাত্রদের জীবনের একটি অংশ চলচিত্রে উঠে আসলে ভবিষ্যতের গবেষনায় এই ছবি মুল্যবান অবদান রাখতে পারত।নিঃসন্দেহে চবি অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে অনেক ভিন্নতা রাখে। ছবির মাধ্যমে পরিচালক শিল্পগুনের যথাযথ বিশ্লেষন দেখিয়েছেন।
একসময় এই চবি ছিল মুক্তচিন্তার প্রানকেন্দ্র। এদেশের অনেক কৃতি সন্তান সৃষ্টি করেছে। কালের বিবর্তনে একসময় চলে যায় সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে। তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র সমাজ কি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে তা আমাদের সময়ের সকলের জানা। ‘৯০ দশকের সংবাদপত্রের মাধ্যমে তা জানা অসম্ভব নয়।সব মিলিয়ে বলব ছবিটি নিঃসন্দেহে অসাধারণ।
নিজের জীবনের মোহকে বিসর্জন দিয়ে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা জাগিয়ে তোলার মধ্য দিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে কামিনি রায়ের কবিতা শিক্ষা দিয়ে গেছে।”পরের কারনে স্বার্থ দিয়া বলিএ জীবন মন সকলি দাওতার মত সুখ কোথাও কি আছে?আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”এমন একটি ছবি করার জন্য প্রদীপ ঘোষের পুরো টীমকে কৃতজ্ঞতা। এটি আন্তর্জাতিক ভাবে যে কোন চলচিত্রের সাথে প্রতিযোগিতা করার যোগ্যতা রাখে। এই ছবির সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করি। কারন এই সাফল্যের অংশীদার আমিও একজন চবিয়ান হিসেবে দাবী রাখি। সকল চবিয়ানদের প্রতি অনুরোধ, পরিবা্রের সবাইকে নিয়ে অন্তত একবার ছবিটি দেখুন আর ফিরে যান আপনার সেই বর্ণিল জীবনের বিশেষ সময়ে।সম্ভব হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সকল ইতিহাস নিয়ে ২য় পর্ব “শাটলট্রেন” করা যায় কিনা আয়োজকদের সবাইকে আরেকবার ভেবে দেখতে বলব।
thanks