|| উম্মে শায়লা রুমকী ||
উম্মেলিনা দাঁড়িয়ে আছে।ভিষন ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। প্রায় সাড়ে তেইশ ঘন্টা কখনো উড়ে, কখনো ক্লান্তিহীন অপেক্ষায় এয়ারপোর্টে বসে! এতো দীর্ঘ উড্ডয়ন পথের সাথে আগে কখনো সে মুখোমুখি হয়নি।জীবনে এই প্রথমবার একা একা আমেরিকা দেখতে এসেছে।সাত বছরের ছোট ছেলেটাকে রেখে আসতে তার মন সায় দেয়নি!কিন্তু নারী উদ্যোক্তা হিসাবে একটা ফেলোশিপ পেয়ে ট্রাম্পের আমস্ত্রনে আমেরিকা ভ্রমনের সুযোগ কয়জনের বা কপালে জোটে!এ তো রাজকপাল!!তাই সহসা এরকম সুযোগ পায়ে ঠেলা যায় কি!!
উম্মেলিনা নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রনে পারদর্শী। জীবন তাকে কম বয়সেই অনেক কিছু শিখিয়েছে।তাই হাসি খুশি মনে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিয়েছে অজানার পথে!ব্যাগ মানে!সেও এক বিশাল ব্যাপার!তার স্বামী নিউমার্কেট ঘুরে বেশ দাম দিয়ে বড় সাইজের এক ট্রলি সুটকেস কিনেছে।উদ্দেশ্য একটা ব্যগে সব ধরে গেলে নিশ্চিন্তে থাকা যাবে।কিন্তু দেখা গেলো নিয়ম অনুযায়ী ৪৭কেজির বেশি ওজন বহন করা যাবে না,তাও দুটো ব্যাগে!অগত্যা বিশাল ট্রলিসহ আরো একটা ছোট ট্রলি,মোট দুটো ব্যাগ নিতে হলো।
এখন সে দুই হাতে দুই ট্রলি নিয়ে ক্লান্তি আর উদ্বেগ নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করছে।ডুলেস ইন্টারন্যশনাল এয়ারপোর্ট খুব একটা বড় নয়!প্রচুর লোকজনের আনাগোনা।নানান দেশের,নানান রঙের।এরই মধ্যে লম্বা একজন আফ্রিকান এগিয়ে এলেন।সাহায্য লাগবে কি না জানতে চাইলো।উম্মেলিনা না সূচক মাথা নাড়লো।সাহায্য করার মতন কিছু নেই।কিছুক্ষনের মধ্যে রবার্ট চলে আসার কথা!
আগের মেইলে এরকমই বলা ছিলো।লাল নীল সাদা রঙের টাই পড়া এক ভদ্রলোক “UMMA” লেখা একটা প্লাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে।ছবিও পাঠিয়েছিলো,তাতে বয়স আন্দাজ করা কঠিন।তবু বেশ বয়স্ক হবার কথা!সাদা চামড়ার দেশে সব লোকই প্রায় একই রকম লাগে!তার উপরে একেকজন এতো লম্বা যে উম্মেলিনার কথা বলতে হলে খানিকটা ঘাড় উঁচু করে বলতে হয়!
রর্বাট হ্যাজেকের তো নটার মধ্যে আসার কথা।দশটা বাজতে চললো, কারো দেখা নেই!সকালে খাওয়া হয় নি বলে উম্মের বেশ ক্ষিদে পেয়েছে! বসার কোনো জায়গা নাই,সবাই নিজেদের ট্যাক্সি বা হাঁটার পথ ধরেছে।রর্বাট সাহেব না আসা পর্যন্ত, এখানেই দাঁড়াতে হবে।কারন যোগাযোগ করার জন্য মোবাইলে নেট বা সিম কোনটাই নাই।
দশটার কিছু পরে একজন হাসিখুশি বয়স্ক লোক এগিয়ে এলেন।হাতে উম্মের নাম লেখা প্লাকার্ড!”গুড মর্নিং” জানিয়ে তার সাথে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন।
লোকটাকে বেশ হাসিখুশি, দায়িত্ববান আর ভদ্রলোক মনে হচ্ছে।তিনি ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে জানালেন দেরী হবার কারন ট্রাফিক।
ট্রাফিক!!শব্দটা শুনে উম্মেলিনার চোখ বিস্ফোরিত হলো।ঢাকা শহরের ট্রাফিকের কথা সে জানে।দেশ থেকে শুনে এসেছিলো,ওসব দেশে ট্রাফিক নাই,সবই সিস্টেমের মধ্যে চলে।তাহলে ট্রাফিক এদেরও আছে!রবার্ট ড্রাইভারকে ট্রাফিক এড়াবার জন্য অন্য পথে যেতে বললেন।
উম্মেলিনার দিকে তাকিয়ে বললেন,আমরা একটু ঘুরাপথে যাবো,ট্রাফিকে পড়তে হবে না,তাছাড়া সুন্দর রাস্তা,চারপাশটা দেখে দেখে গেলাম,কি বলো?
উম্মে মাথা নাড়ালো।কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।ক্ষিদের কারনে আরো ক্লান্ত লাগছে।সে ট্যাক্সির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।
একটা সুন্দর চকচকে ঝকঝকে রাস্তা দিয়ে ট্যক্সি ছুটে চলছে।চারপাশে চিকন পাতার পাইন গাছের মতন সাড়ি সাড়ি গাছ!আকাশ অসম্ভব নীল,মাঝে মাঝে সাদা মেঘ ছুটে চলছে।এদের কি এখন শরৎ কাল?সব দেশে কি শরতের আকাশ একই রকম নীল হয়!আচ্ছা এদের কি কাশফুল ফোটে?এরা কি আমাদের মতন নীল শাড়ি পরে কাশবনে ছবি তোলে?মনের মধ্যে হাজার প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।
কিন্তু ক্লান্তিতে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উম্মেলিনার!পাশে ফিরে দেখে,রর্বাট চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে।তারমানে হোটেলে যেতে আরো সময় লাগবে।উম্মেলিনাও জানালার কাঁচে মাথা এলিয়ে দিলো।চোখ জুড়ে ঘুম পরীরা নেমে এলো সহসাই!
হোটেল ম্যরিয়টে এসে ট্যাক্সি থামলো।একজন বিশালদেহী ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, তিনি ট্যাক্সি থেকে লাগেজ বের করলেন।রবার্ট ইশারায় তার সাথে যেতে বললেন,তাকে ছুটতে হবে, কারন নেপাল থেকে যে আসছে তাকে কোথায় জানি আনতে যেতে হবে!উম্মেলিনা রর্বাটকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রলোকের সাথে সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলো।সাততলায় লিফটে যেতে হবে।হাতে একটা কার্ড দিয়ে রিসিপশন থেকে বলা হয়েছিলো,এটাই না কি রুমের চাবি!!উম্মের ভিষন লিফটে ভয়!দেশে থাকতেও সে কখনো উঁচুতে উঠতে চাইতো না!কিন্তু এখন তো উপায় নাই।ভয়ে ভয়ে সাততলায় এসে পৌঁছালো!কার্ড এদিক ওদিক করে অবশেষে রুমের দরজা খুললো।
কিছুক্ষনের মধ্যে বিশালদেহী ভদ্রলোক ট্রলি দুটো রুমে দিয়ে গেলো।উম্মেলিনার একবার মনে হলো,দুটো ডলার কি হাতে ধরিয়ে দেবে?সাধারনত নিজের দেশে এরকম কুলিদের টাকা ধরিয়ে দিতে হয়,না হলে তারাই চেয়ে নেয়!ভদ্রলোক উম্মের দিকে তাকিয়ে হাসলো!এই হাসির অর্থ কি?ডলার দেন! আপাতত ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় করাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো!
রুমে ঢুকে উম্মের গা ছমছম করতে লাগলো!একা থাকার অভ্যাস নেই।তার উপরে এই বিশাল রুমে আবছা অন্ধকারে কেমন অদ্ভুত শিহরন খেলে যাচ্ছে।দরজার কাছে থাকা সুইচ বোর্ডে চাপ দিতেই ঘরে আলো জ্বলে উঠলো।সফেদ বিছানা দেখে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না,লাফিয়ে বিছানায় পড়তে ইচ্ছে করলো!কিন্তু সেটা করা যাবে না!
রর্বাট সর্তক করে দিয়েছিলো,আমেরিকার টাইম টেবল ধরতে চাইলে তার মতই ব্যবহার করতে হবে।অর্থাৎ রাতের ঘুম রাতেই সাড়তে হবে।তা না হলে দিনের ওয়ার্কশপে ঘুমিয়ে পড়বো।ওদিকে পেটের ক্ষিদে জানান দিচ্ছে,দুপুর হয়েছে!
উম্মেলিনা ওয়াশরুমে গেলো।আপাতত স্নান করতে হবে,বাকি চিন্তা পরে করলেও চলবে।
বাথরুমে বিশাল ঝকঝকে বাথটাব দেখে সে ভিষন খুশি।আপাতত হট সাওয়ার তার ক্ষিদের কষ্ট আর ক্লান্তি দূর করতে পারে।দীর্ঘ সময় ধরে স্নান শেষে মেরুন ট্রাউজারের উপর হালকা প্রিন্টের টপস চাপালো।দেশে থাকলে এসব ঘরোয়া পোশাক।কিন্তু এই দেশে এসব নিয়ে কেউ চিন্তা করে না,ভালো করে কেউ দেখেও না!এই প্রথমবার সে একরকম পোষাকে স্বাধীনতা পেলো!দেশে ঘর থেকে দুপা বের হলে ভালো পোশাক পরতে হয়,কোন অনুষ্ঠানে কি ধরনের মেহমান আসবে,কারা থাকবে, দিনের আয়োজন না রাতের,দূর সম্পর্কের না নিকটাত্মীয়ের পার্টি, এতোসব ব্যাপার মাথায় নিয়ে পোশাক পরতে হয়!এখানে এসবের বালাই নাই,যার যা ইচ্ছে পরতে পারে!কেউ নাক সিঁটকাবে না,ইভ বা আ্যডম কোনো টিজিং করবে না।
কেডস পরে, ব্যাকপ্যাকে শীতের কাপড় নিয়ে উম্মেলিনা খাবারের খোঁজে বের হলো।রিসিপশন থেকে জানানো হলো,সকাল দশটা অব্দি ব্রেকফাস্ট পাওয়া যাবে কমপ্লিমেন্টারি হিসাবে,আর সন্ধ্যায় স্ন্যাকস এবং ওয়াইন ফ্রি।এছাড়া বন্ধ!বলে কি!এখন উপায়?রিসিপশন থেকে জানালো খানিকটা ডান দিকে হেঁটে গেলে কয়েকটা রেস্টুরেন্ট পাওয়া যাবে,বাম দিকে গেলে ফার্মেসি পাওয়া যাবে!স্প্যানিস মেয়েটা বেশি কথা বলতে চাইলো না।
উম্মে ঠিক করলো,রেস্টুরেন্টের সন্ধানে যাওয়াই ভালো।কিন্তু বেশিদূর যেতে ভয় করছিলো তার,যদি ঠিকঠাক ফিরে আসা না যায়!ভরসা জিপিএস সিস্টেম আর হোটেলের নাম ঠিকানা।ওয়াশিংটনে ভদ্রলোকের বাস,তারা নিশ্চয়ই ঠিকানা জানতে চাইলে ভুল বলবে না!আল্লাহর নাম দিয়ে ডান দিকে হাঁটতে শুরু করলো।বেশ কিছুটা হাঁটার পর একটা কফি শপ পাওয়া গেলো।ভিতরে ঢুকতেই কফি এবং চকলেট কেকের গন্ধে উম্মের পেটের ক্ষিদেটা মাথাচাড়া দিলো।বিকেল প্রায় চারটের মতো বাজে,এতক্ষন পর্যন্ত পেটে কিছু পড়েনি।এখন এই কেক আর কফিই ভরসা।দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে কফি আর কেক পাওয়া গেলো।অনেকেই কফি শপের বাইরে রাস্তায় টেবিল চেয়ারে খাচ্ছে।উম্মে তার খাবার নিয়ে বাইরে এলো।একটা টেবিল দখল করে বসে গ্রোগ্রাসে কেক শেষ করলো,তারপর কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
উম্মের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিন গুলোর কথা মনে পড়লো।এরকম রাস্তার ধারে চেয়ার টেবিলে বসে ফুসকা, চটপটি আর চায়ের কাপে চুমুক।পার্থক্য শুধু এদের রাস্তাঘাট পরিষ্কার,মানুষগুলো চিৎকার করে কথা বলে না,হইচই নেই,কফির কাপ, দোকান পাঠ সব ঝকঝকে পরিষ্কার!যাদের খাওয়া শেষ হলো তারা নিজেরাই কাপ প্লেট ভিতরে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে আসলো।দুইজন সুন্দরী স্বল্পবসনা তরুনী রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে,অকারন নিজেদের কথায় হেসে উঠছে,কেউ তাদের খেয়াল করছে না।উম্মেলিনার মনে হলো,সভ্যতার একটা সৌন্দর্য আছে!কারন তার দেশে এরকম দৃশ্যে হা করে দেখার জন্য অন্তত কয়েশ’ লোক জড়ো হতো!নিজেদের মোবাইল বের করে বিনা অনুমতিতে ছবি তুলতে শুরু করতো!এসব কাজ যে অসভ্যতা,অন্যায় সেটা বোঝার মতো সাধারন জ্ঞানটুকু অনেকের নেই!নিজের অজান্তেই উম্মেলিনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
বিকেলটা খুব সুন্দর!নীল আকাশ একটু একটু করে লালচে হচ্ছে!উম্মেলিনার একটা সানগ্লাসের শখ অনেকদিনের!চায়না মার্কেট কাছাকাছি হবার কথা!জিপিএস দেখিয়ে দিচ্ছে কোনদিকে যেতে হবে!দেশে থাকতে সে কখনো জিপিএসের এমন সহজ ব্যবহার দেখেনি।গুগল যদি বলে ডানে অনেক ট্রাফিক বাস্তবে হয়তো সেরকম নয়!কিন্তু এই দেশে দেখি অন্ধের হাতে মোবাইল থাকলেই সেও ঠিক জায়গায় পৌঁছে যাবে!
চায়না মার্কেটে তেমন ভীড় নেই।অনেক সুন্দর করে সাজানো,দেখলেই মন ভরে যায়!উম্মেলিনা অবাক হয়ে দেখছে,ঘুরছে কিন্তু কিছুই কিনছে না।কারন প্রায় সবকিছুই বাংলাদেশী টাকায় রুপান্তর করলে অনেক দাম।তাছাড়া প্রথম দিনই টাকা খরচ করা বোকামি।তারচেয়ে প্রয়োজনীয় সানগ্লাসটা খুঁজে দেখা দরকার।উম্মেলিনা আরো খানিকটা হেঁটে একটা সানগ্লাসের দোকানে এসে দাঁড়ালো!এতো দাম আর অভিনব ডিজাইনের বাহার দেখে সে খানিকটা অবাক হলো।কিছুই করার নেই!অবশেষে বিশ ডলারে একটা মোটামুটি ধরনের সানগ্লাস কিনলো।
বাইরে তখন রোদের আলো প্রায় নেই বললেই চলে তবু সে রোদচশমাটা চোখে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।খুব অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলো,তার ভয় করছে না।বরং এই একাকী বিকেলটা অসাধারন হয়ে তার কানে কানে বলছে,জীবনের চেয়ে উপভোগ্য আর কিছু নয়!
হোটেলে ফিরতে হবে!আলো নিভতে শুরু করেছে।কিন্তু এই শীত শীত আমেজে তার কোথাও থামতে ইচ্ছে করলো,বসতে ইচ্ছে করলো সবুজ ঘাসে।ওয়াইট হাউজের পিছনের দিকে একটা পার্কের দেখা মিললো।বেন্চিতে বসে দূরের হোয়াইট হাউজ চোখে পড়ে।উম্মেলিনা একটা বেন্চিতে বসে পড়লো।সূর্যটা ডুবতে শুরু করেছে।মনে মনে ভাবছে,এই একই সূর্য নিজের দেশেও ডুবে যায়,একই রঙের আভায় আকাশে ছড়িয়ে যায়,কোথাও রঙের তারতম্য নেই,আলো দিতে কার্পন্য নেই।অথচ মানুষে মানুষে কত পার্থক্য!কত ভেদাভেদ!গায়ের রঙে কত বর্নবাদ!!
লেখক: ফিজিওথেরাপি কনসালটেন্ট, পিটিআরসি