সেজান মাহমুদ
লেখক পরিচিতি: কথাশিল্পী, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার, পেশায় চিকিৎসা বিজ্ঞানী। ইউনিভার্সিটি অব সেন্টার ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনে সহকারী ডিন ও প্রফেসর হিসাবে কর্মরত।
ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির দোতলায় অনেক জিনিসের ভিড়ে একটা টিনের বড় বাক্স পেয়েছিলাম যা ভরতি ছিল নানান রকমের কাপ। পিতল, রূপা, এমন কি সোনার প্রলেপ দেয়া ফুটবল কাপ। এগুলো সব আমার বাবার জয় করা।
ছফুট দু ইঞ্চি উচ্চতার এই মানুষটি জীবনে ফুটবল খেলা ছাড়া আর কিছু করতেন না। সত্যিকার অর্থেই আর কিছু করেন নি। শুনেছি বাবা যখন ক্লাস এইটে পড়তেন দূরের একটা বোর্ডিং স্কুলে তখন কলেরা হয়ে পরিবারের কর্ণধার আমার চাচা এবং তাঁর পরিবারের সবাই মারা যান। তখন এই অষ্ঠম শ্রেণীর বালককে ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে সংসার এবং ব্যবসার দায়িত্ব দেয়া হয়। ব্যবসা কেমন করেছেন একটু বলি; সিরাজগঞ্জের জামতৈল ট্রেন স্টেশনে আমাদের একটা বেশ বড় গুদামঘর ছিলো।
সেখানে দার্জিলিং থেকে গরম মসলা আমদানি হতো। সেই গুদামের এক কর্মচারী সিরাজ মিয়া অসুস্থ হয়ে গেলে বাবা ডাক্তার ডেকে তার চিকিৎসা করালেন। সিরাজ মিয়াঁর স্ত্রী এসে বাবার হাত ধরে বলেছিলেন ‘আপনি যা করলেন তা বাপের কাম। আজ থেইক্যা আপনি আমার বাপ।’ তো এখন সিরাজ মিয়া হয়ে গেলেন মেয়ের জামাই। মেয়ের জামাই কে তো কিছু দিতে হয়, তিনি সেই গুদাম ঘরের ব্যাবসা দিয়ে দিলেন। তখন আমার বড় ভাই ছাড়া আর কারো জন্ম হয় নি। মায়ের মুখে এই গল্প শুনেছি বহুবার। আর সিরাজ মিয়াও যে আমাদের আপন দুলাভাই না একথা বড় হবার আগে জানতামই না। কারণ তিনি সত্যিকারের জামাই এর মতোই আমাদের বাড়িতে আসতেন ঘটা করে বিরাট রুই মাছ, মিষ্টি এইসব নিয়ে।
এই সিরাজ মিয়ার মতো আরও অনেক পরিবার আমাদের বাড়িতে থেকেছে ছেলে-মেয়ে সহ; তাদের কেউ কেউ লেখাপড়া করে আমার ভাইবোনের চেয়েও বড় হয়েছে জীবনে। সবাই জীবিত আছে এখন। যাইহোক, ফুটবল পাগল এই মানুষটির একটা স্মৃতি আবছা মনে পড়ে। তাঁকে খেলার জন্যে হায়ার করতে আসতো লোকে। একবার ঘোড়ায় চড়িয়ে নিতে এলো খেলার জন্যে। আমার খুব গর্ব হয়েছিল মনে মনে। আর খেলায় জিতলেই খাসি জবাই হতো বাড়িতে। রেডিওতে কলকাতার মোহনবাগান এর খেলার ধারাবিররণী শুনতে শুনতে মোহনবাগান জিতলেই বাড়িতে মচ্ছব হতো । কিন্তু প্রচুর জমিজমাতেও তো টান পড়ে এক সময়। জমিজমা আর কৃষিকাজ দিয়েই তো ছয় ছেলেমেয়ের লেখা পড়া, সংসার, অন্যদের দেয়াথোয়া। আমি যখন মেডিক্যাল এ থার্ড ইয়ারে তখন বাবা মারা যান হার্ট এটাকে। তাঁর জন্যে তেমন কিছুই করার সুযোগ হয় নি।
আমি মনে হয় ফুটবল খেলার মধ্য দিয়ে বাবাকেই মনে করি; বাবার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখি নিজের ফুলবল-প্রীতির মধ্য দিয়ে। সকাল থেকে অথই-প্রেম উৎসব করছে; দু’জনে বাজার ক’রে আনলো মাকে সঙ্গে নিয়ে; রান্না করলো মজার মজার খাবার- স্টেইক, লবস্টার। বানালো বাবা দিবসের নাটক। আমার বাবার সঙ্গে আমার কোন ছবিও নেই। সব মিলিয়ে যেমন উত্তেজনায় আছি তেমনি মনটাও খারাপ… বাবাকে কোনদিন বিশাল স্ক্রিনে বা স্টেডিয়ামে বসিয়ে ফুটবল খেলা দেখানো যাবে না আর! অথই প্রেমের মতো রান্না ক’রেও খাওয়ানো যাবে না আর!!
পৃথিবীর সব বাবাদের শুভেচ্ছা জানাই আর প্রতিদিন হোক বাবা দিবস! কেউ যেন অকালে বাবাকে না হারায়!!!