নাফিসা তাসনীম অনু
বিয়ে প্রায় হয় হয়। বউ আসবে ঘরে। এত্ত বড় সংসার! অথচ খাট নেই কোনো,ডাইনিং টেবিল একটা নেই। ছুটির সকালের মাঝামাঝি এ সময়টাতে বাবা পত্রিকা পড়েন। মুখ ঢাকা থাকে পত্রিকার উলটো পাশে, আমি দাঁড়িয়ে অভিমানী কাণ্ণা চেপে বলতে থাকলাম, ‘খাট চাই আমার, ডাইনিং টেবিলও একটা’। বেড়াতে গিয়ে এক বাড়ীতে নতুন ডিজাইনের টেবিল দেখেছি, ঠিক ওরকম।
“কি রকম”?
“গোল মতন, কিন্তু সেটা গোল না, আবার চারকোনাও না, এমন”। বাবা যেমনি পত্রিকা নামিয়ে শুনলেন খানিক, তেমনি আবার উঠিয়ে পড়তে শুরু করলেন। এমন রাশভারী, নিতান্ত-ভাষী মানুষের বকবকানি কন্যা আমি! বুকে ধড়ফড় নেই কোনো, উপরন্তু দুদিন পর পর কেবল আবদারী আবেদন। সারাজীবন কয়টা কথা বলে গেছেন, তা বোধ করি গুণেও বলা যাবে। আমার জীবন-মরণ প্রয়োজন ভুলে পত্রিকার পাতায় ডুবে গেলেন বলে অভিমান আরো গাঢ় হল। ছেলে পুতুলের বিয়ে হচ্ছে,কত কাজ যে বাকি, চোখ মুছে বিয়ের কার্ড বানাতে ফিরে গেলাম। দিন কয়েক পরে মিস্ত্রি-গোছের কে এক বাড়ীতে এসে আমার খোঁজ করতে লাগলো। আমার লোভী চোখ তার দুই হাতে স্থির। গোল একটা কাঠের তৈরি টেবিল, সঙ্গে একটা খাট।‘সাআর এগুলান পাডাইসে’। মিস্ত্রীকে ফরমাশ দিয়ে রাখা ছিল,আমার বলে রাখা গোল টেবিল (আসলে বলতে চেয়েছিলাম oval শেপ) আর সঙ্গে খাট একটা। ধুমধাম করে পার হয়ে গেল আমার পুতুল বিয়ে।
ছোটবেলাটাতে যে বাড়িটাতে থাকতাম, তার ছিল ২২ ধাপের লাল রঙ্গা কাঠের সিঁড়ি। আমরা পায়ের ছন্দ শুনে বুঝে যেতাম কে উঠে আসছে ওপরে। বাবা ফেরার শব্দ পেয়ে ছুটে নেমে যেতাম তার ১০ ধাপ। এই ধাপ কটা আমায় কোলে নিয়ে যেতে হবে ওপরে। একদিন ও বিরক্ত হতে দেখিনি, বিরক্ত হয়ে যেত মা। “অফিস-ফেরত মানুষটার ওপর এত অত্যাচার, আহ্লাদীপনায় মেয়ে মানুষ হবে না কোনদিন”, এইসব আরকি।
শায়ান, রাজু, ওদের অবাক প্রশ্ন ছিল, ‘চাচার সঙ্গে কথা বলস কিভাবে, ভয় লাগে না? থাকো কিভাবে বাসায়?’ ওয়ার্কহলিক, অবিচারে চির-প্রতিবাদী মানুষটার ভেতর-ভরাট সংবেদনশীলতা আমার ছোট ছোট প্রয়োজন পূরণ করে গেছে আজীবন। হয়ত আমার বন্ধুরা আসবে বাড়িতে, হাত ভরে খাবার কিনে আনতেন অফিস ফেরার পথে। মশারী টানালাম কিনা, সকালের নাস্তাতে ডিমটা রেখে উঠে আসলাম কি-না, সবদিকে সমান নজর। কোনদিন আলগোছে বলেছি হয়ত, ইউনিভার্সিটিতে খুচরোর দরকার পড়ে খুব, ফটোকপিতে, আলুর চপ খেতে কিংবা আরো কিছু। দু-একদিন পর পর খুচরো দিয়ে যেতেন নিয়ম করে, ভুল হত না। ঈদে প্রথম শাড়ী কিনব, অথচ মায়ের সঙ্গে পছন্দের আসমান জমিন ফারাক। ভিড়ে দাঁড়িয়ে বাবা দেখে গেছেন, একবুক অভিমান নিয়ে ফিরে এসেছিলাম সেদিন। তারও পাঁচ ছয় মাস পর কলকাতাতে গেলেন কাজে, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায়, পরে ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করান, সেও তিনবার। যদি কোথাও ভুল হয়ে থাকে কোনো, এজন্য। তবু ডাক্তারের জানাতে হল, তিনি বাঁচবেন, জোর বড় তিন মাস। একজন ডাক্তার যার জীবন-সময় বেঁধে দেয়, কে জানে-তার ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়ার অনুভুতি হয় কি-না। কলকাতা থেকে ফিরলেন, সঙ্গে আনলেন ঠিক সেই শাড়ীটা। এরপর আর দেড়মাস বেঁচেছিলেন, ওটাই ছিল তার দেয়া শেষ উপহার।
আমাকে যদিও ডাকা হয় ‘ওনু’ নামে, বাবার ডাকে আমি ছিলাম অ—নু। বিরক্ত হয়ে একদিন জানতে চাইলাম, ‘তাল নাই, ছন্দ নাই, সুর নাই, মাধুরী নাই, খুঁজে-বেছে ছেলেদের একটা নাম—পারলে রাখতে!?’
‘কেন, এটাতো সুন্দর। ছোট্টো আর আদরের’।
বাবা তোমার দেয়া ‘অ—নু’ নাম; একটু টেনে ডাকা, ভীষণ মিস করি আজও।