মিলি সুলতানা।
অভিনেত্রী আনুশকা শর্মার চমৎকার প্রতিভা ঠিকরে ঠিকরে বের হচ্ছে। ছবি নির্মাণের প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছেন। তাঁর নির্মিত ফিল্লোরি, এনএইচ টেন এবং পরী দেখেছি। খুব মুগ্ধকর বিষয় নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন তিনি। আনুশকার নির্মিত ছবির বৈশিষ্ট্য হল নারী প্রধান গল্প বা উইম্যান এম্পাওয়ারমেন্ট নিয়ে। তবে বুলবুলে এসে দেখা গেল তীব্র প্রতিবাদে এলিয়ে পড়েছেন। ওয়েব প্ল্যাটফর্মে বুলবুল আনুশকার দ্বিতীয় উপহার। ছবির কাহিনী বেছে নিয়েছেন খুব যত্ন করে। ঘটনাকাল ১৮৮১ সালের। কোলকাতার বাংলা অঞ্চলের প্রেক্ষাপটের বাল্যবিবাহ, জমিদার প্রথা ও রাজবাড়ির অন্দরমহলে দাফন হয়ে যাওয়া অত্যাচার আর্তচিৎকার তুলে ধরা হয়েছে। বুলবুলের বাল্যবিবাহ হয় প্রৌঢ় জমিদার বড়ঠাকুরের (রাহুল বোস) সাথে। ছবিতে রাহুল বোস দ্বৈত চরিত্রে। মেজোঠাকুর পাগল মহেন্দ্র’র স্ত্রী বিনোদিনীর (পাওলি দাম) মন বিষেভরা। বালিকা বুলবুল ধরে নিয়েছিল বড় ঠাকুরের ছোটভাই সত্যপ্রকাশের (অবিনাশ তিওয়ারি) সাথে তার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পিঁড়িতে বসার সময় বুলবুলের হাতে পুতুল ছিল। বিয়েটাকে সে বুঝেছে বালক সত্য’র সাথে পুতুল খেলার মত। বাসরঘরে স্বামী বড়ঠাকুরকে দেখে ভয় পায় বুলবুল। তাকে জিজ্ঞেস করে, “সত্য কোথায়? তাকে দেখছিনা কেন? আমার বিয়ে তো সত্যের সাথে হয়েছে!!”
২০ বছর কেটে যায়। বালিকা থেকে যুবতীতে পরিণত হয় বুলবুল (তৃপ্তি দিমরি)। কিছু দৃশ্য দম আটকে দেয়ার মত। যেমন, বুলবুলের জমিদার স্বামী বড়ঠাকুর যখন দেবর সত্যপ্রকাশের সাথে প্রেম টের পেয়ে ছোটভাই সত্যকে লন্ডনে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে দেয়। সত্যের বিরহে বুলবুল ভেঙে পড়ে ভেতরে ভেতরে। আর এটাকেই মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে পাগল মেজোঠাকুরের বউ বিনোদিনী। যদিও বিনোদিনীর সাথেও বড়ঠাকুরের দৈহিক সম্পর্ক ছিল। বুলবুল আর সত্যপ্রসাদ ছাড়া জমিদার প্রাসাদের চার দেয়ালের ভিতরের অনাচারে অভ্যস্ত সবাই। বুলবুলের বিরহ নিয়ে বড়ঠাকুরের কানে বিষের পেয়ালা ঢেলে দেয় মেজো জা বিনোদিনী। ক্রোধে অন্ধ হয়ে বড়ঠাকুর স্নানরত বুলবুলকে চুলের মুঠি ধরে বাথটাব থেকে নামিয়ে উপুড় করে লোহার রড দিয়ে নির্মমভাবে পেটায়। বুলবুলকে রক্তাক্ত করে তার দুইপায়ের পাতা থেঁতলে দেয়। তরুণ চিকিৎসক সুদীপ (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) বুলবুলকে চিকিৎসা দেয়। পায়ের পাতা ব্যান্ডেজ করে ঝুলিয়ে রাখে। এমন অবস্থায় পাগল মেজোঠাকুর বুলবুলের রুমে প্রবেশ করে। শারীরিকভাবে মারাত্মক পর্যুদস্ত বুলবুলকে দেখে তার মাথায় যৌনলিপ্সা চাপে। যন্ত্রণার মধ্যে যন্ত্রণা দিয়ে বুলবুলকে ধর্ষণ করে মেজোঠাকুর। ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে দম ছেড়ে দেয় বুলবুল।
বুলবুলের মৃত্যু দেখে ঘাবড়ে যায় পাগল ঠাকুর দৌঁড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় বিনোদিনীর বিছানায়। বিনোদিনী ঠোঁটে আঙুল চেপে মেজোঠাকুরকে চুপ থাকতে বলে। ঠিক এই সময় দেখানো হয় মা কালীর মূর্তি। প্রকৃতিতে প্রতিশোধের ঝড় উঠে। মা কালীর আশীর্বাদ পৌঁছে যায় মৃত বুলবুলের নিথর শরীরে। সে প্রাণ ফিরে পায় এবং প্রতিশোধে গর্জে উঠে। বুলবুলের গৃহবধূর ফর্ম বদলে যায় –হয়ে ওঠে ডাইনি। পাগল মেজোঠাকুরের ঘাড় কামড়ে হত্যা করে। এভাবে সমাজের খারাপ পুরুষদের রক্ত চুষে হত্যা করে ডাইনিরূপী বুলবুল। এই কাজে তাকে সহায়তা করে তার ডাক্তার বন্ধু সুদীপ (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়)। বুলবুলের শেষ শিকার ছিল তার স্বামী বড়ঠাকুর। অসম্ভব সুন্দর একটি ছবি বুলবুল। আনুশকা শর্মার অনবদ্য সৃষ্টি। ছবির সিনেমাটোগ্রাফির অপূর্ব দিক উল্লেখ না করলেই নয় — রক্ত, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসার সময় লাল রঙের থিম দেখানো হয়েছে। গা চমকানো ছমছমে ভয়ের সময় নীল রঙের আবহ দেখানো হয়েছে। ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শকের চোখ পর্দায় আটকিয়ে রাখবে। বুলবুলির আরেকটি অসাধারণ দিক ছিল নারীবাদের ঝলক —প্রযোজক নারী (আনুশকা শর্মা), পরিচালক নারী (অনভিতা দত্ত), মুল চরিত্র নারী (তৃপ্তি দিমরি)। বুলবুল চরিত্রের জন্য তৃপ্তি দিমরিকে বাছাই করে দর্শকের মন ভরিয়ে দিয়েছেন আনুশকা শর্মা।