এবিএম সালেহ উদ্দীন
সর্বজনীন কথাটির অর্থ ব্যাপক। তবে যার দ্বারা সকলের জন্য হিতকর ও মানুষের স্বার্থে নিজেকে যিনি বিলিয়ে দিতে পারেন, সর্বজনীন কথাটি সে রকম লোকের বেলায় খাটে। এমন একজন মহামানব কাজী নজরুল ইসলাম, যিনি তাঁরা চিন্তা-চেতনা ও জীবনদর্শনের সবকিছুই মানুষের স্বার্থে নিবেদন করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম দিকপাল। তাঁর শিল্প-সাহিত্যের প্রতিটি শাখা ছাড়াও সমগ্র মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন। শিশুকাল থেকেই তাঁর ভেতরে বিস্ময়কর প্রতিভার দীপ্তি পরিলক্ষিত হয়। স্কুলে খুব বেশি দিন পড়তে হয়নি তাঁকে। স্রষ্টার দয়া ও কৃপায় তিনি অসাধারণ মেধা ও মননচিন্তায় একজন অপরিসীম প্রতিভাধর ব্যক্তিতে পরিণত হন। অচিরেই সাধারণ থেকে অনন্য সাধারণে উপনীত হন। একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে উপরতলার প্রতিটি মানুষের অন্তরে তাঁর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়ে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সৈনিক জীবন, কুলি-মজুর ও দক্ষ রাজনৈতিক চিন্তা-ধারায় তিনি একজন শ্রেষ্ঠতম মানুষে প্রতিষ্ঠিত হন। তাঁর সাহস ও দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে তিনি সর্বস্তরের মানুষের কান্ডারি হিসেবে পরিগণিত হন। উপমহাদেশের গ্লানিযুক্ত সমাজে কবি-সাহিত্যিকের মধ্যে নজরুল একজন স্বাধীনতাসংগ্রামী মহাপুরুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। গণ-মানেুষের স্বার্থে তাঁর প্রতিবাদী চেতনা ও সাহস ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
তরুণ বয়সেই ১৯২২ সাল থেকে মাত্র বছর দশেকের মধ্যে বাংলা সাহিত্যাকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। বাঙালির দিগন্তজুড়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এমন আকাশজোড়া জনপ্রিয়তা ভারতবর্ষে আর কারো বেলায় ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। সর্বস্তরের মানুষের আস্থা এবং অপরিসীম ভালোবাসা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই নজরুলের ক্ষেত্রে সর্বজনীন তথা সব মানুষের কল্যাণার্থী ও সময়ের সারথি কথাটি প্রযোজ্য। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের শেষার্ধে মূলত সমগ্র পৃথিবীটাই ছিল অস্থির এবং টলটলায়মান। প্রথম মহাযুদ্ধের ঘনঘটা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চরম বৈষম্যের ফলে সমগ্র ভারতবর্ষের সর্বস্তরের জনগণের জীবন ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী। দারিদ্র্যের কশাঘাত, দুর্বলের প্রতি সুবিধাভোগীদের অত্যাচার ও নিপীড়নের মাত্রা ছিল তুঙ্গে। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিস্ময়কর প্রতিভা। ভারতবর্ষের নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের মুক্তির দিশারি হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর আকাশচুম্বী মনন ও সৃজনক্ষমতা, বলিষ্ঠ সাহিত্যবোধ ও তাঁকে মানব ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। যিনি গণমানুষকে জাগিয়ে তোলার নিমিত্তে বিরামহীন কাজ করেছেন। শিল্প-সাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রাণশক্তি নিয়ে জ্বালাময়ী গান ও বিদ্রোহী কবিতা লিখে সমগ্র ভারতবর্ষে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে এই দিক থেকে তাঁর সমকক্ষ আর কেউ নেই। বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন, তেজোদ্দীপ্ত চেতনাশক্তি এবং আধুনিক মনন-চেতনায় সবার উপরে মানুষ সত্য এবং মনুষ্যত্ববোধই হচ্ছে তাঁর কাব্য ও সাহিত্যজগতের প্রধান চালিকাশক্তি। নিপীড়িত মানুষ ও মানবতার স্বার্থে তাঁর সংগ্রামী জীবন ও কর্মের ঔজ্জ্বল্যে সকল মানুষের অন্তর স্পর্শ করে আছে। ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষের অবহেলিত মানুষের কল্যাণের জন্য তিনি লিখেছেন, যুদ্ধ করেছেন এবং মানুষের স্বার্থে কথা বলেছেন। প্রবল মানবতাবোধের
ভিত্তিতে তিনি ভারতবর্ষের হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খিষ্ট্রানসহ সকল ধর্মমতের মানুষকে একই বৃন্তে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কাউকে বড় কিংবা ছোট করে দেখার মানসিকতা তাঁর মধ্যে ছিল না বলেই সকলের মধ্যে ঐক্যসূত্র স্থাপনের চেষ্টা ছিল তাঁর প্রাণের দাবি। সকল মানুষ দ্বন্দ্ব-বিবাদ-মারামারি-হানাহানির ঊর্ধ্বে ঐক্যবদ্ধভাবে একই দেশে মিলেমিশে থাকবে; এটা ছিল তাঁর সাহিত্যাদর্শের মূল বিষয়। তিনি দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা করেন : ‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ মুসলিম-ক্রীশ্চান।’
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আদর্শ নির্মাতা হিসেবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রাণপুরুষ। আমরা তাঁর মাধ্যমে সাহিত্যের অনেক দুর্লভ অভিজ্ঞতা লাভ করছি। অনন্তকাল ধরে নজরুলের মানবাদর্শ বাঙালিরা তাদের জীবন ও কর্মে প্রয়োগ করতে পারবে। তিনি সকল মানুষকে কতটা ভালোবাসতেন তাঁর কবিতা, গানসহ সমগ্র সৃষ্টিসম্ভারের পরতে পরতে তা বিশ্লেষিত হয়েছে। তিনি কী অপূর্ব দ্যোতনায় মুসলিম ঐতিহ্য এবং হিন্দু ধর্মসহ সকল ধর্মমতের উপকরণগুলো সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন। তিনি কোনো বাঁধাধরা ছকে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি বলে সর্বজনীন মানস-সত্তাই ছিল তাঁর সাহিত্যাদর্শের মূল উৎস।
নজরুল সব মানুষকে একই কাতারে শামিল করার তাগিদ সৃষ্টি করেছেন বলেই তাঁর সাহিত্যসম্ভারকে নিয়ে অনেকে ঈর্ষাকাতর ছিলেন। কিন্তু সর্বপ্রকার বাধা-বিপত্তিকে উতরে সত্যিকার অর্থে নজরুলই হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের আদর্শ নির্মাতা। নজরুল যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখনো ‘কৈফিয়ত’ কবিতা র নার মধ্য দিয়ে তিনি স্বীকার করেন, কেন মুসলমানদের একটা অংশ এবং কট্টর হিন্দু মৌলবাদীরা কেন তাকে সমাজচ্যুত করার চেষ্টা করেছে। মোল্লারা কাফের, হিন্দুরা তাঁকে নেড়ে বলে ঘৃণা করেছে। গান্ধীবাদী অহিংস আন্দোলনের লোকেরা নজরুলকে অতিবিপ্লবী বলে আখ্যা দেয়। ঈর্ষাপরায়ণ সেসব মানুষের কথায় রুষ্ট ও ক্ষুব্ধ না হয়ে বরং মানবতার ঐক্যকেই মুখ্য হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শোষক শ্রেণি এবং তাদের দোসরদের অত্যাচার-নিপীড়ন যখন তুঙ্গে, নির্যাতিত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের হাহাকারে সমগ্র ভারতে চরম অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয় ও ধর্মীয় কুসংস্কারপূর্ণ সজাত সংস্কৃতির অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশের ভারতবর্ষের স্বাধীনতা হরণকারী ব্রিটিশ শাসকদের চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে একটি বিকাশমান আলোর মশালি জ্বালান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সমগ্র ভারতবর্ষের নিপীড়িত মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ, দুঃখ-কষ্ট, বর্ণবৈষম্যমূলক অরাজকতার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে আলো জ্বালানোর দৃপ্ত প্রয়াসে ধূমকেতুর মতো তাঁর আবির্ভাব ছিল অনেকটা আলো-আধাঁরির মতো। একদিকে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রতন্ত্রের শোষণ-প্রক্রিয়া, ব্রিটিশ তোষণকারীদের দালালি ও বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যদিকে মুক্তচিন্তা, গণবিপ্লব তথা স্বাধীনতাসংগ্রামকে বেগবান করার ব্যাকুলতা। এমন একটি দোলদোলায়মান পরিস্থিতিতে বাংলার সাহিত্যাকাশে আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব।
কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাজীবন ছিল খুবই স্বল্পকালের। পারিবারিক অর্থকষ্ট, নানা রকম সংকট ও সমস্যার কারণে অল্প বয়সেই তিনি বিদ্যালয় ছাড়েন। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও নিদারুণ অভাব-অনটনের মধ্যেই তিনি বড় হন। তীব্র আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যেও তিনি কখনো ধৈর্যহারা হননি এবং মনোবল হারাননি। বরং সাহসের সাথে তিনি সবকিছুর মোকাবিলা করেছেন।
কিশোর বয়স থেকেই নজরুলের ভেতর ছিল এক অপ্রতিরোধ্য চেতনা। স্বভাবচতনার নিজস্ব দুরন্তপনায় তিনি ছিলেন অন্য সবার চাইতে ব্যতিক্রম। তীক্ষ্ম মেধা, বুদ্ধি-বিবেক ও বিচক্ষণতায় তিনি ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। সমাজের নানাবিধ অবক্ষয়, অত্যাচরর-নিপীড়ন, ধর্মান্ধতা ও যাবতীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনীশক্তি ও চেতনা ছিল অত্যন্ত প্রখর। যৌবনের শুরুতেই তাঁর মধ্যে প্রবল মানবিক চেতনা ও বৈশিষ্ট্য বিরাট পরিবর্তনের আভাস ফুটে উঠেছিল।
সেই চেতনা হচ্ছে সমাজের বৈষম্যের অপনোদন ঘটিয়ে মানবতার সামগ্রিক মুক্তি। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা। এ জন্য যেকোনো অন্যায় দেখলেই তিনি প্রতিবাদ করতেন এবং রুখে দাঁড়াতেন।
ভারতবর্ষের অবহেলিত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য এক ব্যগ্র-ব্যাকুল পরিস্থিতিতে যৌবনে পা দেওয়ার আগেই নজরুল সামরিক বাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগদান করেন এবং ১৯১৭ সালে চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ব্রিটিশশশাসিত সামরিক ব্যারাকেই তিনি সাহিত্য-সাধনা ও কাব্যর না শুরু করেন। সে সময় থেকেই নজরুলের কবিতা ও বিভিন্ন লেখা কলকাতার শীর্ষ পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। অল্প দিনের মধ্যেই নজরুলের মাঝে এক বিস্ময়কর সাহিত্য-প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। সামরিক বাহিনীর কঠোর নিয়মের মধ্যে থেকেও নজরুলের এই সাহিত্য জাগরণ সর্বমহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেনাবাহিনীতে থাকাকালে করাচি, নৌশেরা, লাহোরসহ বিভিন্ন স্থানে সামরিক ট্রেনিংয়ের সময় নজরুল বেশ কিছু সাহিত্য রচনা করেন। সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অনেক কিছুই সেসব লেখায় প্রকাশ পায়। নজরুলের রচিত ব্যথার দান, রিক্তের বেদনসহ বেশ কিছু গল্প ও কবিতা এবং বাঁধনহারা উপন্যাসে সামরিক বাহিনীর কষ্ট- কঠিন চরিত্রসমূহ মর্মস্পর্শীভাবে ফুটে উঠেছে। এ সময় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং মানব বিধ্বংসের করুণ চিত্র নজরুলকে খুব পীড়িত ও বিচলিত করে তোলে। বিশ্বজয়ের নামে মানবতা ধ্বংসের উন্মাদনায় সাম্রাজ্যবাদী দুশমনদের বিরুদ্ধে নজরুলের মাঝে প্রতিবাদী চেতনা দানা বেঁধে ওঠে। সেনাছাউনিতে ব্রিটিশ সৈন্যদের বৈষম্য এবং তাদের আধিপত্যবাদী মানসিকতায় নজরুলের ক্ষোভ বেড়ে যায়। এক সময় তিনি সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি নিয়ে মুক্ত জীবনে ফিরে আসেন। সামরিক বাহিনীর কঠিন সময় পেরিয়ে কলকাতায় শুরু হয় নজরুলের নতুন জীবন। সাহিত্যের নবধারা। সাহিত্যের সকল শাখায় শুরু হয় সদর্প বিচরণ। পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখি ছাড়াও তিনি গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন কাব্য-সাধনা ও সংগীত রচনায়। সময়োপযোগী মানবতাবাদী কবিতা, স্বাধীনতা ও মুক্তির জ্বালাময়ী গানে জেগে ওঠে সমগ্র ভারতবর্ষ। কলকাতার শীর্ষ পত্রিকার পাতায় পাতায় নজরুলের ক্ষীপ্রকায় লেখাসমূহ ছাপা হতে থাকে। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের একটি অগ্নিনির্ঝর উপাখ্যান। এই সুদীর্ঘ কবিতাটি তিনি লিখেছিলেন ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ এক ঝড়ের রাতে। যে ঝড় বিদ্যমান ছিল প্রকৃতিতে; তার চেয়েও প্রকট ছিল সমগ্র ভারতবর্ষের গণমানুষের অন্তরের ঝড়। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়নে উপমহাদেশের অধিকারহারা মানুষের বিক্ষুব্ধ মনের ঝড় বয়েছিল অবিরাম। সমাজের বৈষম্য-যাতনার সংক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও প্রতিকারের এক চিরন্তন প্রতিবাদের ঝড় সর্বস্ব কাব্যগাথা উপাখ্যান কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি কলকাতার বিজলী পত্রিকায় বিদ্রোহী কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরে যায়। বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে হই ই ও
তোলপাড় শুরু হয়।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অপ্রতিরোধ্য সাহিত্য চেতনায় বাংলা সাহিত্যের বিস্ময়কর জাগরণ সৃষ্টি হয়। নজরুলের গল্প-কবিতা, গান ও সুর-লহরীতে বাংলার আনাচে-কানাচে জেগে উঠেছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও দুশাসনের বিরুদ্ধে কাজী নজরুল ইসলামের কলম ছিল একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এই হাতিয়ার বাংলা সাহিত্যের শক্তিমত্তাকে শতগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল, যখন তিনি কবি হিসেবে মানুষের কল্যাণে আপসহীন ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। স্বাধীনতার পক্ষে গণমানুষের মুক্তি ও অধিকার লড়াইয়ের প্রেরণা উদ্দীপক একটার পর একটা কবিতা ও গান রচনা করে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে কাঁপিয়ে তুলেছিলেন।
আগেই উল্লেখ করেছি, নজরুলের বিপ্লবী চেতনায় সেই সময়কার অনেক নামকরা কবি-সাহিত্যিক ঈর্ষান্বিত হয়ে নজরুলকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেন। ‘আনন্দময়ীর আগমনী’ নামে কবিতা লেখার জন্য নজরুলকে যখন ব্রিটিশ সরকার কারাগারে নিক্ষেপ করে, তখন অনেক সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী খুশি হন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সেই সময়কার কবি-সাহিত্যিকেরা মুখ খোলেননি। নজরুলকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য চেষ্টা করেননি। তাঁকে ছাড়ানোর দাবি-দাওয়া করেননি। বরং তিনি নিজেই আদালতের কাঠগড়ায় বিচারকের সামনে রাজবন্দীর জবানবন্দী উপস্থাপন করেন। সত্যবোধের ওপর টিকে থেকে এমন সাহসী ভূমিকা ভারতবর্ষে অন্য কারো বেলায় দেখা যায় না। কোনো কোনো কবি- সাহিত্যিক সেবা দাসত্বের নমুনা হিসেবে ব্রিটিশ রাজন্যবর্গের প্রতি ভক্তিপূর্ণ স্তূতিগাথা কবিতা ও সাহিত্য র না করেছিলেন।
নজরুল কখনো অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। কখনো শোষক ও তাদের সেবাদাসের দলে ভেড়েননি। শোষিতের কাতারে শামিল হলেন এবং অধিকারবঞ্চিত মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য কলম ধরলেন। গণমানুষের স্বাধিকার আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে তাঁর শাণিত লেখনী সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে। সাধারণ মানুষ তাঁর লেখা ও গানে অনুপ্রাণিত হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানবতার মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনে নজরুলের জ্বালাময়ী কবিতা, গণসংগীত ও গানগুলো যুগে যুগে মানুষের অধিকার ও মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রেরণা জোগাবে। শিল্প-সাহিত্যসহ সর্বক্ষেত্রে সমান দখল ছিল নজরুলের জীবনে। তেমনই তাঁর সাহিত্যে ক্ষেত-মজুর, শ্রমিক, ধনী-গরিব এবং সকল ধর্মমতের মানুষের কথা উঠে আসে।
সর্বক্ষেত্রে একটি সর্বজনীন মনন চেতনার মধ্য দিয়েই নজরুলের মানস ফুটে উঠেছে।
বর্তমান বিশ্ব আজ হিংসার কোপানল আর মানববিধ্বংসের উন্মত্ততায় জর্জরিত। চারদিকে শুধু মানবতার হাহাকার। সন্ত্রাস, আধিপত্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রতাপে কেঁপে উঠছে মানুষের এই সুন্দর পৃথিবী। এখানে আজ সত্যিকার কান্ডারি নেই। অযোগ্য-অথর্ব শাসকের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারটুকুও পাচ্ছেন না। এই পথভ্রষ্টদের অপশাসনে মানুষ দিশেহারা। এখানে আমাদের মহান কবি নজরুল ইসলামের সেই কবিতাটি মনে পড়ছে : ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,/ ছিঁড়িতেছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত?/ কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।/ এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।/ হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?/ কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’
পৃথিবীতে মানুষের মুক্তি ও অধিকারের সংগ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের মতো মহামানব ভারতবর্ষে বিরল।
আজকের অত্যাচারি শোষকশ্রেণির অবক্ষয়ী হিংসাব্রত ও হানাহানির সমাজে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো লোকের বড়ই প্রয়োজন। যিনি আমাদের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে আশার আলো ছড়াবেন। সত্যিকার মানুষের মনুষ্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রেরণা জোগাবেন।
কাজী নজরুল ইসলামকে বুঝতে হলে তাঁর সৃষ্টিসম্ভারের ওপর অধ্যয়ন করতে হবে। তাঁর সাহিত্যের অনন্ত সমাহারের মধ্যে ডুব দিতে হবে। নজরুলের সাহিত্য ও জীবনধারা যত বেশি স্টাডি করা হবে, ততই তাঁর ভেতরকার মানসকে আবিষ্কার করা যাবে। এ জন্য আমাদেরকে চিন্তা-চেতনার প্রতি সম্মান জানাতে হবে। নজরুলের রেখে যাওয়া আকাশচুম্বী সাহিত্যসম্ভার চিরকাল আমাদের মননজগতের জন্য বিরাট সম্পদ। নজরুলকে শুধু গান ও কবিতার মধ্যেই বিচার করা যায় না। তিনি বিশ্ব মানবতার কল্যাণে একজন অবতার ছিলেন। তাঁকে নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা ও গবেষণা করতে পারলে আমরা যেমন উপকৃত হব, তেমনি দেশ ও সমাজ উপকৃত হবে।
সত্যের পক্ষে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তিমান মহামানব বাংলা সাহিত্যের অন্যতম মহাপুরুষ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মানবতার স্বার্থে তিনি অবিস্মরণীয় ও চির অনির্বাণ। আমরা কখনো যেন তাঁকে ভুলে না যাই।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।