শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : সাধারণ প্রচলিত অর্থে আদিবাসী শব্দটির অর্থ বুঝায় কোন অঞ্চলে আদি হতে বসবাস করে আসছে যে মানুষগুলো তারাই আদিবাসী, অপরদিকে আক্ষরিক অর্থে নৃ শব্দের অর্থ নর বা মানুষ, আর নৃ-গোষ্ঠি অর্থ হলো মানব গোষ্ঠি। ক্ষুদ্র নৃৃ-গোষ্ঠি বলতে বুঝায় কোন অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা অনুপাতে কম সংখ্যক জনসংখ্যার যে সম্প্রদায় রয়েছে তারাই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি। তাই শাব্দিক অর্থের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি এবং আদিবাসীর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দ্বন্ধ। এই দ্বন্ধটির যৌক্তিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন দরকার, এবং সৃষ্ট দ্বন্ধের সুরাহারও প্রয়োজন। নৃৃ-ত্বত্ত্ব নামক মানুষ সর্ম্পকীত বিদ্যায় এতদ সম্পর্কীত বিষয়টির দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, এই তত্ত্বটির উদ্ভব হয়েছে মানুষের অতীত এবং বর্তমান আচরণ এবং সভ্যতা নিয়ে অনুশীলন করার জন্য। মানুষের অতীত সংস্কৃতি এবং আচরনসহ জীবন প্রণালীর বিভিন্ন দিক নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষন করেই আজকের মানব সভ্যতায় মানুষ কি করে পৌঁছল তা জানা যায়। প্রকৃতিতে প্রাণী ,উদ্ভিদ এবং মাটির হাজার বছর ধরে নানা ধরনের পরির্বতন ঘটেছে, আর এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানব সভ্যতারও পরিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন যুগে প্রকৃতির পরির্বতনের ফলে পরিবর্তিত পরিবেশে জীবন ধারনের জন্য মানুষের জীবন যাপন পদ্ধতির পরির্বতন ঘটে। প্রায় কয়েক কোটি বছরের বয়সি পৃথিবীর প্রাণীর জগতের ইতিহাস পর্যবেক্ষন করলে দেখা যায়, জীবন ধারনের জন্য মানুষ পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানের ঘুরে বেড়িয়েছে। এভাবেই এক স্থানের মানুষের সঙ্গে অন্য স্থানের মানুষের মিশ্রণ ঘটে আর এ ধরনের সংমিশ্রণের ফলে নতুন জাতি, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠির সৃষ্টি হয়। প্রকৃতি যদি তার নিজস্ব গতিতে চলতো, তাহলে আজকে সারা দুনিয়ায় পরিবেশগত যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে তা হয়তো হতো না। পরিবেশের এই ভারসাম্যহীন অবস্থা সৃষ্টির জন্য মানুষই দায়ী। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সংমিশ্রণের ফলে যে জনগোষ্ঠির উৎপত্তি হয়েছে, ঐ মানুষগুলি কতৃক উদ্ভাবিত প্রযুক্তিই পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করেছে, আদি মানুষ যারা অর্থ্যাৎ আজকে যাদেরকে ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠি বলে অভিহিত করা হচ্ছে, তারা প্রকৃতির পরিবেশের তেমন কোন ক্ষতি করে নাই। বর্তমানে পরিবেশ গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, পৃথিবীর আদিবাসী জনগোষ্ঠিই বিশ্বের ৮০ শতাংশের বেশি পরিবেশের সাংস্কৃতিক এবং জীববৈচিত্র রক্ষা করেছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠির বাইরে বিশ্বে যে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে তারাই পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র নষ্ট করে। আর এই কারণে প্রকৃতি এবং পরিবেশ হারিয়েছে ভারসাম্য। ফলে পৃথিবীতে প্রতিবছর ঘটে নানা রকমের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, এ ধরনের বিপর্যয়ের কবলে পড়ে প্রাণ হারায় লক্ষ লক্ষ মানুষ।( indigenous People) যারা তারাই পৃথিবীর আদি মানব গোষ্টি কারণ পৃথিবীর প্রকৃতি পরিবেশকে যথাযথ লালন করে আসছে। আদিবাসীদের লালনের কারণেই প্রকৃতির ভারসাম্য এর ধারাটি কিছুটা সচল আছে। বর্তমানে আদিবাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে কম জনসংখ্যার পরিণত হওয়ার ফলে তারা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠি হিসেবে চিহ্নিত। আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠি নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার। ১৯৫৭ সালে জাতিসতত্ত্বার আত্ব-পরিচয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পৃথিবীর এই মানব গোষ্ঠির অধিকার সংরক্ষণ করার উদ্যেশ্যে, আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা কতৃক একটি কনভেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই কনভেশনে আদিবাসী ও ট্রাইবেল জনগোষ্ঠি কনভেশন ১৯৫৭(১০৭) গৃহিত হয়, ১৯৮৯ সালে গৃহিত ধারাটি পুনসংস্করণ করে ১৯৮৯ (১৬৯) করা হয়। এভাবে জাতিসংঘের শ্রম সংস্থা কতৃক আদিবাসী জনগোষ্ঠির অধিকার সংরক্ষণের জন্য দুটি ধারা গ্রহনের মাধ্যমে আদিবাসীদের সমাধিকার দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়। ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আর্ন্তজাতিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠি দিবস (International Day of the world indigenous People) বা আস্তর্জাতিক দিবসটি ৪৯/২১৪ বিধিমালায় স্বীকৃতি পায়। এই আর্ন্তজাতিক দিবসটি বিশ্বের ৯০ টি দেশে ৩৭০ বিলিয়ন মানুষ আর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে। জাতিসংঘ কতৃক ১৯৯৩ সালকে আদিবাসী বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছিল। এই ঘোষণার মূল উদেশ্য ছিল, বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি বা আদিবাসী জনগন নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়, ভূমির অধিকার, অঞ্চল বা টেরিটরির অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ও নাগরিক মর্যদা যাতে করে স্বিকৃতি পায়। সারা পৃথিবীতে হাজার সম্প্রদায়ের আদিবাসী আছে। কানাডা অষ্ট্রেলিয়ায় ৫২টি, আমেরিকায় এবং আজেন্টিনায় রয়েছে অসংখ্য আদবাসী জাতির জনগোষ্টির সম্প্রদায়। মুলত এই আদিবাসীরাই উল্লেখিত দেশগুলোর প্রাচীন নাগরিক। ইউরোপীয় সমুদ্র অভিযাত্রী কিস্টোফার কলম্বাস ১৪৯২ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকা অঞ্চলে গমন করেন। কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের ফলে এই দেশগুলোতে ইউরোপীয় অঞ্চলের মানষেরা অভিবাসন শুরু করে, আমেরকিার দুই মহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল এখন ইউরোপীয় বংশদ্ভুতদের শাসনাধীন। এই অঞ্চলের আদিবাসীরাই এখন সংখ্যালঘু তাদেরকেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি হিসেবে অভিহিত করা হয়। আমেরিকায় যাদের আধিবাসী বলা হয় তারাই হলো এই অঞ্চলের প্রাচীন বাসিন্দা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, এই অঞ্চলে আদিবাসীদেরই এখন ভূমিতে মালিকানা নেই। এই অঞ্চলের আধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূমি এবং আলাস্কাতে যে আদিবাসীরা বসবাস করেন, এরা সবাই এশিয়া অঞ্চল থেকে অভিবাসী হয়ে এখানে এসেছিল। নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে, এই আদিবাসীরা এশিয়া অঞ্চল থেকে ৪০ হাজার বছর আগে এসে আমেরিকার মূল ভু-খন্ড এবং আলাস্কায় বসতি গড়ে তুলে। কালের বিবর্তনে ঘটেছে নানা ধরনের পরিবর্তন। আর এই পরির্বতনের ফলে বদলে গেছে বসবাসকারী মানুষগুলো সংস্কৃতির ধারা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময় ঘটেছে সংস্কৃতির আগ্রাসন আর এ ধরনের আগ্রাসনের কবলে পড়ে সংস্কৃতির ধারাগুলোও বদলে গেছে। ১৬০৭ সালে জেমসটাউনে ইংরেজদের দ্বারা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় আমেরিকার ভার্জিনিয়া উপনিবেশ। ১৬২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্লিমাথ উপনিবেশ (ইংরেজি plymouth)। ১৬২৮ সালে ম্যাসাচুসেটসে বে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার উদ্যেশ্যে বিপুল অর্থায়নের ফলে ইংরেজদের মধ্যে অভিবাসনের জোয়ার বয়ে যায়। ১৬১০ সালে শেষ দিকে বৃটিশরা তাদের দেশের ৫০ হাজার বিপ্লবীদের আমেরিকা উপনিবেশে স্থানান্তর করে। ১৬৩৪ সালে আমেরিকার পিরিটানে ১০ হাজার বিদেশি আবাস গড়ে তোলে। ক্রমাগত ইউরোপীয়দের অভিবাসনের ফলে আমেরিকার প্রাচীন বসবাসকারীরা তাদের সংস্কৃতির ধারাটি হারায়। অষ্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড এর ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যায়, ইউরোপীয়রাই ঐ অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলে তারপর আস্তে আস্তে ইউরোপীয় সংস্কৃতির ধারাটি ছড়িয়ে দেয় ফলে নিউজিল্যান্ড এবং অষ্ট্রেলিয়ায় ফলে এখানেও বদলে যায় প্রাচীন সংস্কৃতি।
ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু মানুষকে নেগ্রিটো সাবষ্ট্রেটে ফেলা হতো। দৈহিক গঠন এবং গায়ের রঙের মিল থাকায় ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষ গুলোকে নেগ্রিটো বলা হয়। এই নিগ্রেটো পিপলসরা সম্ভবত দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ার অষ্টালয়েড মেলানেশিয়ান অধিবাসীর বংশধর। অনুকল্পনা করা যায় যে, ভেদ্দারা এই অঞ্চলের সর্ব প্রথম অধিবাসী। এই অঞ্চলে ৬০ থেকে ৭০ হাজার বছর পূর্বে ভেদ্দারা বসবাস করতো। নৃ-ত্বাত্তিক রণধীর আল এটের একটি গবেষণায় থেকে জানা যায়, ভেদ্দারা শ্রীলংকার প্রথম অধিবাসী। ভারত বর্ষের অধিবাসীদের সঙ্গে আগমনকারী জনগোষ্ঠির মিশ্রণের ফলে আজকের ভারত বর্ষের ভিন্ন ভিন্ন ধরনের গোষ্ঠি ও সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে।
ধারাবাহিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতা থেকে পৃথিবীর সব সভ্যতা থেকে প্রাচীন। ভারতীয় উপমহাদেশ বলতে বুঝায় ভারত, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান এবং বার্মাকে। নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে আজ থেকে ১৫ লক্ষ বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। এই উপমহাদেশে ৩০ হাজার বছর আগে সিন্দু সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। এই কারণে ধরে নেওয়া যায় যে, আমেরিকার আলাস্কায় ৪০ হাজার বছর পূর্বে যে এশীয়রা বসতি গড়ে তোলে তারা এই উপমহাদেশেরই মানুষ ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশে পৃথিবীর সব অঞ্চলের আগে সভ্যতা উন্মেষ ঘটেছিল বলে এখানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এসে বসতি গড়ে তোলে। আর্যদের আগমনসহ নানা ধরনের সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠির বসতি স্থাপন করেছে ভারতীয় উপমহাদেশে। আর এ কথার প্রমান মেলে বর্তমানে বসবাসরত জনগোষ্ঠির বৈশিষ্টগত ভিন্নতায়। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখানে অভিবাসন স্থাপন করা প্রাচীন জনগোষ্ঠি হলো সাওতালরা। সাওতালরা আদি-অষ্ট্রেলিয় (প্রোটো- অষ্ট্রালয়েড) বংশধর। বিভিন্ন নৃ-তাত্ত্বিকদের মতে, ৩০ হাজার বছর আগে এই উপমহাদেশে সাওতালরা বসতি গড়ে তোলে। সাওতাল আদিবাসীদের মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো গোত্র । প্রতিটি গোত্রের রয়েছে নিজস্ব ভাষা , ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ধারা । সাওতালরা অষ্ট্রিক ভাষাভাষি। অভিবাসন গমানাগমন হিসেবে সাওতালরা ভারতীয় উপমহাদেশের পুরাতন বাসিন্দা। সাওতালদের বসতি গড়ে তোলার পর এই অঞ্চলে আর্য , দ্রাবিঢ়দের আবির্ভাব ঘটে। সুতরাং এই অঞ্চলের কৃষি আবাদের প্রচলনটা সাওতাল জনগোষ্ঠিই সূচনা করে। উপমহাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য এখানে শুরু হয় ভিন্ন ভিন্ন রকমের শস্যের আবাদ। বছরের বারো মাসেই কৃষি শস্য উৎপাদিত হয় এই অঞ্চলে ।
উপমহাদেশের ভারত, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভূটান, নেপাল এবং মিয়ানমার স্বাধীন রাষ্ট্র। ভারতের অনেক গুলো প্রদেশের নাগরিকরা আদি জাতিগত স্বত্তা নিয়ে বাস করছেন। এই প্রদেশ গুলির অধিবাসীদের রয়েছে নিজস্ব স্বকীয়তা যা তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে। যদিও কেন্দ্রীয় শাসন দ্বারা সমগ্র ভারত পরিচালিত হয় তবে প্রদেশ গুলির ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি বিকাশে রাজ্য সরকার নিজস্বতার পরিচয় দিচ্ছে। দক্ষিণ ভারতের কিছু প্রদেশ, ঝাড়খন্ড, মণিপুর. নাগাল্যান্ড, মিজোরামসহ কিছু প্রদেশ তাদের আদি সংস্কৃতি ধারাটি অব্যহতভাবে ধরে রেখেছে। ভূটান, নেপাল, শ্রীলংকার সংস্কৃতির ধারায় প্রাচীন নির্দশনটা খুজে পাওয়া যায়। পাকিস্তানের অনেক আদিবাসীরা বেদুইন, তারা যাযাবরের মত জীবিকা নির্বাহ করে। মিয়ানমারে রয়েছে ১৩৯টি জাতির জনগোষ্ঠির। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির তালিকা থেকে রাষ্ট্রীয় ভাবে তারা রোহিঙ্গাদের নাম বাদ দিয়েছে।
বাংলাদেশে বাঙালিদের বাইরে ২৯টি ক্ষুদ্র নৃ-ত্বাত্ত্বিক সম্প্রদায় রয়েছে যারা আদিবাসী। এই আদিবাসীদের সংখ্যা ১২ লাখ ৫ হাজার প্রায়। আদিবাসীদের একটি অংশ সমতলে বসবাস করে, তারা ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, আরেকটি অংশ পাহাড়ে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে (বর্তমানে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) বসবাসরত। এক সময় বাংলাদেশে আদিবাসীদের উপজাতি বলা হতো, বর্তমানে সরকার আদিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি হিসেবে সাংবিধানিক সিকৃতি দিয়েছেন। বাংলাদেশের সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে সাওতাল, মুন্ডা, গারো, হাজং, মাহালী, রাখাইন, মণিপুরী উল্লেখযোগ্য। পাহাড়ে বসবাসরতদের মধে চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরা, তঞ্চস্যা, ম্রো,মম, পাংখো, খুমি, খেয়াং, লুসাই, চাক উল্লেখযোগ্য। মূলত বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ অঞ্চল। কয়েক হাজার বছর আগে এই ভু-খণ্ডটি সাগর গর্ভ থেকে জেগে উঠা ভূমি। তাই ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এখানে বসবাসকারী মানুষ গুলো সবাই কোন না কোন ভাবে অভিবাহিত হয়ে এখানে এসে বসতি গড়ে তোলেন।
সারা বিশ্বের সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আদিবাসীরাই সভ্যতার উষা লগ্নে কৃষির প্রচলন ঘটায়। প্রাচীন কালে আদিম মানুষের জীবনযাত্রা শুরু হয়েছিল, পশু শিকার ও বনবাদাড়ের ফলমূল সংগ্রহ করার মাধ্যমে। কৃষির আবাদ শুরু হওয়ার পর মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে স্থায়ী ভাবে বসতি গড়ে তোলেন। ঐ সময়েই উর্বর ভূমি এবং ভালো আবাদের আশায় পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মানুষ ঘুরে বেড়ায়। প্লাবন সমভূমি উর্বর ছিল তাই দেখা যায় নদী অববাহিকায় মানুষ তার বসতি গড়ে তোলেন, তাছাড়া নদী ছিল যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম, এভাবেই শুরু হয় অভিবাসন প্রক্রিয়া।
পৃথিবীর ভিন্ন দেশে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির বা আদিবাসী হিসেবে যে জনগোষ্ঠি রয়েছেন তাদের অধিকাংশদেরই ভূমির মালিকানা নেই। তাছাড়া বেশির ভাগ আদিবাসীরাই ভূমি মালিকানায় বিশ্বাসী ছিলেন না। পৃথিবীতে কৃষি প্রচলন শুরু হয় কমিউনিটি বেজড চাষাবাদের মধ্যমে। প্রাচীন কালে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতো আর তখন বসবাস করা আশপাশে ভূমিতেই শুরু করে কৃষির আবাদ। বসতি গড়ে তোলা এলাকাটির মালিক হয় সমাজবদ্ধ সব মানুষ। তাই দেখা যায়, কৃষি আবাদ শুরুর প্রাক্কালে ব্যক্তিগত ভূমির মালিকানা ছিল না। এর ধারাবাহিকতার প্রভাবটি আদিবাসী জনগোষ্ঠির মাঝে বিদ্যমান থাকায় তারাও ভূমির মালিকানা ব্যক্তিগত নামে দখল করেনি।
আদিবাসীরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ন্যায় বাংলাদেশেও সমাজবদ্ধ ভাবে বন-জঙ্গল পরিস্কার করে ভূমিকে আবাদী করে গড়ে তোলে। তাদের বিশ্বাস ছিল, সামাজিক ভাবে তারা ভূমির অধিকার পাবে আর বংশপরম্পরায়। এর উত্তারাধিকারী হিসেবে নতুন প্রজন্মই ভোগ করবে তাদের কতৃক আবাদী করা ভূমি। কিন্তু বৃটিশ শাসনামলে এদেশে ভূমির মালিকানা প্রথা চালু হয়। বৃটিশ আমলে অধিকাংশ আদিবাসীরা ভূমির মালিকানার বিষয়টি বৃটিশদের কাছ থেকে বুঝে নেয়নি।
ফলে দেখা যায়, বাংলাদেশের সমতলে শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ আদিবাসীই ভূমিহীন। পাহাড়ে বর্তমান সরকার আদিবাসীদের ভুমি অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য ভূমি কমিশন গঠন করেছেন, কিন্তু সমতলের আদিবাসীদের ভূমি বিরোধ বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য কোন কমিশন নাই।
সম্পদ এবং সম্পত্তিতে কোন মানুষের নিজস্ব মালিকানা না থাকলে, সেই মানুষটির সমাধিকার সমাজে প্রতিষ্ঠা পায় না। তাই সমতলেও পাহাড়ি আদিবাসীদের মত ভূমি কমিশন গঠন করে আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই আদিবাসীরা প্রকৃত সমাধিকার পাবে।
লেখক :- কলামিস্ট