এবিএম সালেহ উদ্দীন,লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।
বাংলা সাহিত্যের নিবেদিত প্রাণ সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০১০) জন্মসূত্রে সৈয়দ আবদুল মান্নান। পরে নামকরণহয় আবদুল মান্নান সৈয়দ। বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য কবি,ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, গবেষক,সাহিত্য সমালোচক, চিত্রকর ও অধ্যাপক। অবিভক্ত ভারতের পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার জামালপুর নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যখন জন্মেছেন, তখন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ চলছিল। একই সাথে সময়টি ছিল দুর্ভিক্ষের কাল। ১৯৫০ সালের দিকে পশ্চিমবঙ্গে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হলে পিতা সৈয়দ এম এবদরুদ্দোজা সপরিবারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে পালিয়ে চলে আসেন। বাবা ছিলেন কলকাতার সরকারি চাকুরে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেছিলেন। চাচাও ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। কবির রতগর্ভা মাতা কাজী আনোয়ারা মজিদও ছিলেন সুশিক্ষিতা এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। স্ত্রীর নাম সায়রা সৈয়দ রানু এবং কবির একমাত্র কন্যার নাম জিনান সৈয়দ শম্পা।
প্রথমে নবাবপুর সরকারি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচ এস সি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণহন। তুখোড় মেধাবী ছাত্র হিসেবে শিক্ষা জীবনের প্রতিটিতেই তিনি খুব ভালো রেজাল্ট করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৩-৬৪সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাস করেন।পরবর্তী সময়ে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর সাহিত্যচর্চা এবং প্রস্তুতিপর্ব শুরুহয়েছিল সেই সপ্তম শ্রেণিতে পড়ালেখা করার সময় থেকে। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার জীবনে লেটো পিরিয়ড আছে।নজরুলের মতো। পিরিয়ডটা হলো ক্লাস সেভেন/এইট থেকে এমএপাস পর্যন্ত। আমি বিরামহীন লেখালেখি করতাম আর ছবি আঁকতাম। কিন্তু আব্বা আমার লেখা প্রকাশিত হতে দিতেন না। ওইপিরিয়ডে আমি নিজেকে ক্রমাগত শিক্ষিত ও সংস্কৃত হওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার কঠোর আব্বা আমাকে পড়ালেখায় বাধ্য করেছেন, যেন আমি এম এ পাস করি। এ জন্য ১৯৬৫ সালকে আমি ধরি আমার আত্মপ্রকাশের বছর।’ সিলেটের এম সি সরকারি কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর চাকরি জীবন শুরু হয়। তারপর ফরিদপুরের শেখ বুরহানুদ্দীন কলেজে চাকরি করার পর জগন্নাথ কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেন। ১৯৯৮ সালে অবসর গ্রহণ করার পর তিনি ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির প্রথম স্কলার ইন রেসিডেন্স পদ মর্যাদায় নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সংগ্রামী জীবনকে গ্রথিত করে পূর্ণাঙ্গ নজরুল জীবনী রচনার দায়িত্ব নেন।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ‘পোয়েট ইন রেসিডেন্স’। এছাড়া নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।তিনি ছিলেন বাহান্ন পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার জাগরণের নিবেদিত কর্মী ও একজন ভাষা সৈনিক।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকালীন সময় থেকে কবিতা লিখতে শুরুকরেন। ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে তিনি সাহিত্যকর্মে নিবেদিতছিলেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। কবিতার গতিময় আবর্তনে মৃত্যু চেতনা, রোমান্টিকতা ও সুররিয়ালিজমকেপ্রতীক হিসেবে তাঁর অ্যাবসার্ডধর্মী ভাবনার কাব্য চিন্তার প্রতিফলন মুখ্য হিসেবে দেখা যায়। সাহিত্যের সাধনায় তিনি আজীবন গবেষণারত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের বেশ কয়েকজন কবি ও সাহিত্যিকের সাহিত্য কর্মের ওপর বিরামহীন গবেষণায় নিমগ্ন আবদুল মান্নান সৈয়দের ভমিকা ছিল সবার উপরে। সারা জীবন একজন নিভৃতচারী গবেষক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। ছন্দের ওপর ছিল তাঁর ব্যাপক নিরীক্ষা ধর্মী সাধনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছন্দেরওপর তাঁর শিক্ষক ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও অধ্যাপক প্রবোধ চন্দ্র সেন। ছন্দ নিয়ে ব্যাপক পড়াশোনা ওজ্ঞান অর্জন করেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ একজন সুপ্রতিষ্ঠিত খ্যাতিমানসব্যসাচী লেখক। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তাঁর ছিলঅবাধ বিচরণ। সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রেই তার সাফল্যের স্বাক্ষর রয়েছে।বাংলাদেশে সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে তাঁর মতো পরিশ্রমী,মেধাবী, নিষ্ঠাবান লেখক ও গবেষক খুব একটা পাওয়া যায় না।সাহিত্যে আত্মমগ্নতাই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত। শৈশবথেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ও গভীর ভালোবাসা অটুট ছিল। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। বাহান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের পক্ষে এবং বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে তিনি ছিলেন সর্বদা তৎপর। বাংলা ভাষার জাগরণের পক্ষে তিনি প্রচুর লেখালেখি করেছেন। সিলেটের সরকারি কলেজে শিক্ষকতার সময় তৎকালীন আয়ুব সরকার বিরোধী লেখার অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ও হুলিয়া জারি করা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর ষাট দশক থেকে বাংলাদেশে সাহিত্য সমালোচনায় এবং সাহিত্য কর্মে নিরলস গবেষণায় তিনি অদ্বিতীয় এবং তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান দুই বাংলায় ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও জীবনান্দ দাশের ওপর তাঁর উল্লেখযোগ্য গবেষণা কর্ম ও রচনা সাহিত্যাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত এবং তিনি এ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন।
এ ছাড়া কবি ফররুখ আহমদ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, বেগম রোকেয়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সমরসেন, আবদুল গনি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, প্রবোধচন্দ্রসেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিককে নিয়েও বই লিখেছেন এবং প্রচুরগবেষণা করেছেন। তিনি ছদ্মনাম ‘অশোক সৈয়দ’ নামে পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন।বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি হিসেবে আবদুল মান্নান সৈয়দ স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক আগে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে,কবিতায় তিনি স্যুররিয়ালিজম তথা পরাবাস্তববাদী চিন্তাশৈলীরনতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তিনি স্বীয় কবি কণ্ঠস্বরকে অনন্য একনতুন ধারায় উচ্চকিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর কবিতায় ব্যতিক্রমী সৃজনক্ষমতা ও মননশীলতার প্রবল ব্যঞ্জনা আছে। আধুনিক বাংলা কবিতার জাগরণ আছে। কবিতার ছন্দকে সাবলীল আঙ্গিকে দ্যুতিময় করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
এই হিসেবে একজন আত্মমগ্ন শুদ্ধতম কবি হিসেবেও তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিকের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা ছিল। নিজস্ব তাগিদেই তিনি তাঁদের সাহিত্য কর্মের ওপর পড়াশোনার মাধ্যমে এক এক করে প্রত্যেকের ওপর গবেষণা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।মহা প্রয়াণের বছরখানেক আগে তিনি মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র ও পল্লীকবি জসীম উদ্্দীনকে গবেষণা শুরু করেও শেষ করে যেতেপারেননি। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, ‘কবি জীবনানন্দকে নিয়ে আমি যে পরিমাণ গবেষণা করেছি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে আরো গবেষণা করা উচিত ছিল।ফররুখ আহমদ অনেক বড় মাপের কবি।এত বড় কবি জসীম উদ্্দীনের ওপর কোনো কাজ করতে পারিনি।’
৫০ বছর যাবৎ সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত কবি আবদল মান্নান সৈয়দের কবি জীবন ছিল বহু বাঁকে বৈচিত্র্যময় ও বর্ণাঢ্য। আধুনিক কবিতার শৈলী নির্মাণ ও কথা সাহিত্যে তাঁর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার জন্য তিনি সব্যসাচী লেখক হিসেবে স্বীকৃতি ও সুখ্যাতি অর্জন করেন।১৯৬৭ সালে ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ নামে আবদুল মান্নান সৈয়দের প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও গবেষক মোহম্মদ মাহফুজ উল্লাহ এবং শাহাবুদ্দীন আহমদের গবেষণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি নজরুলচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।জীবন মিছিল অন্বেষণে তিনি কখনো অলসভাবে বসে থাকেননি। সাহিত্যের নানান বিষয় নিয়ে তিনি সর্বদা ব্যস্ততায় ন্যস্ত থাকতেন। নিরলস সাহিত্য গবেষণায় তাঁকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিল; যা থেকে তিনি বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।
বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যেকাব্যগ্রন্থ : জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭), জ্যোৎ¯œা রৌদ্রেরচিকিৎসা (১৯৬৯), সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪), কবিতা কোম্পানীপ্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২), পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮৪), পার্কস্ট্রিটে এক রাত্রি (১৯৮৩), মাছ সিরিজ (১৯৮৪), সকল প্রশংসা তার(১৯৯৩), নির্বাচিত কবিতা ও আমার সনেট।ছোটগল্প : সত্যের মতো বদমাশ, চলো যাই পরোক্ষে, মৃত্যুর অধিক লালক্ষুধা, নেকড়ে হায়েনা ও তিন পরী। প্রবন্ধ : বিবেচনা ওপুনর্বিবেচনা, দশ দিগন্তে স্রষ্টা, নির্বাচিত প্রবন্ধ, আমারবিশ্বাস, করতলে মহাদেশ এবং ছন্দ।গবেষণাগ্রন্থ : কালান্তরের যাত্রী। উপন্যাসের মধ্যে : পরিপ্রেক্ষিতের দাসদাসী, অ তে অজগর, কলকাতা, পোড়া মাটির কাজ, হে সংসার হেলতা ইত্যাদি।
এছাড়া নব্বইয়ের দশকের দিকে বাড পাবলিকেশন্স থেকে‘ক্ষুধা প্রেম আগুন’ ও ‘প্রবেশ’ নামের দুটি উপন্যাসও বেরহয়েছিল। আত্মজৈবনিক অভিজ্ঞতার আলোকে গল্পভাষ্য বিনির্মাণেতিনি ছিলেন পারঙ্গ ও বিশেষভাবে পারদর্শী। সমাজ, দেশ ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রবল সৃজনক্ষমতার অধিকারী।কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখা জীবনী গ্রন্থের মধ্যে নজরুল ইসলাম : কবি ও কবিতা, বেগম রোকেয়া, জীবনানন্দ দাশ, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, শাহাদাত হোসেন, প্রবোধচন্দ্র সেন, আবদুল গনি হাজারী ও সুধীন্দ্রনাথদত্তের সুনির্বাচিত কবিতা ইত্যাদি।
স্মৃতিকথা : ভেসেছিলাম ভাঙা ভেলায় ও প্রণীত জীবন।গ্রন্থনা ও সম্পাদনা : জীবনানন্দ দাশের কবিতা, ফররুখ আহমদেরশ্রেষ্ঠ কবিতা, ফররুখ রচনাবলী (১-২ খÐ বাংলা একাডেমি), ইসলামীকবিতা : শাহাদাত হোসেন, বাংলাদেশের কবিতা, বাংলাদেশের ছড়া,মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন স্মৃতি অ্যালবাম, সমর সেনের নির্বাচিত কবিতা, মোহিতলাল মজুমদারের নির্বাচিত কবিতা, বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা ও মোজাফফর আহমদের পত্রাবলী প্রভৃতি।জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থ : শুদ্ধতম কবি (১৯৭২), জীবনানন্দ দাশ(১৯৮৪), জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৬), জীবনানন্দ দাশেরপত্রাবলী (১৯৮৭), জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯) ও জীবনানন্দ দাশ(১৯৯৩)। নাট্যকার হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি আছে। তিনি কাব্য নাট্য প্রহসন, একাঙ্ক, শ্রæতিনাট্য, পূর্ণাঙ্গ নাটক ওঅনুবাদ নাটক লিখেছেন। ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর নাট্য গুচ্ছ ও নাট্যধর্মী লেখনীর সংকলন নাট্য সমগ্র (২০০৯) প্রকাশিত হয়। কয়েকটি ছোট গল্পের বিষয়কে নিয়েও তিনি নাট্যরূপ দিয়েছেন।
এছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি কাব্যনাট্য লিখেছেন।সেগুলো হচ্ছে বিশ্বাসের তরু, জ্যোৎরৌদ্রের চিকিৎসা,ঈশ্বর প্রাপ্তির ছোট্ট গাঁথা, চাকা, কবি ও অন্যেরা এবং আটতলার ওপরে।তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ কবি আবিদ আজাদ প্রতিষ্ঠিত শিল্প তরু প্রকাশনা সংস্থার উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।কবি ও সব্যসাচী লেখক আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্য কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও পদকে ভ‚ষিত হয়েছেন। এরমধ্যে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, নজরুল পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ), নজরুল পদক, কবিতালিম হোসেন পুরস্কার, লেখিকা সংঘ পুরস্কার ও অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি।আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর সাহিত্য কর্মের জন্য চিরকাল অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অনির্বাণ হয়ে থাকবে তাঁর সকল কীর্তি। কবিতায় তাঁর শুদ্ধতম অবস্থিতি ছিল খুবই জোরালো। এ প্রসঙ্গে দুয়েকটি কবিতার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করা যেতে পারে।‘অগ্নির অমোঘ জাগরণ’ কবিতায় তিনি লেখেন :‘অনেক দাহের শেষে আজ মেনে নিই এ-ই স্বাভাবিক,পাথরে জাগ্রত হয় অগ্নি, পাহাড়ে প্রপাত,অফুরান জ্যোৎজ্বলে ওঠে তমস্বিনী রাত।’সৌন্দর্য বোধ হচ্ছে মানুষের মননের শ্রেষ্ঠতম অলংকার এবং অহংকার।পরিশীলিত মনের পরিমিতিবোধ ও প্রতীতির মাধ্যমে কর্মময় জীবনের সাফল্যের সৌন্দর্যকে প্রকাশ করতে হয়। পৃথিবীতে মানুষের আয়ু ষ্কালের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানকে যথার্থ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যবোধ প্রকাশ করতে হয়। মানুষ সতত সুন্দরের পূজারি।সুন্দর জীবনকে উত্তম কর্মের মাধ্যমে উৎকৃষ্ট করে তোলা হচ্ছে মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অর্থময় জীবনই সবার কাম্য। হজরত আলী(রা.) একজন বড় কবি ছিলেন। কর্মহীন আলস্য জীবনকে তিনি খুব অপছন্দ করতেন। কর্মময় জীবনের ওপর তিনি ছিলেন সর্বদা সচেষ্ট।তিনি বলেন, ‘জীবন হোক কর্মময়; নিরন্তর ছুটে চলা। চিরকাল বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তো কবর পড়েই আছে।’কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ কখনো অলস জীবন কাটাননি। তিনিতাঁর কর্মময় জীবনকে সৌন্দর্যের আঙ্গিকে সাজাতে চেয়েছেন।একটি কবিতায় সুন্দরকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন :‘পার্কের রাস্তা, তুমি চ’লে গেছো একটু বেঁকেকোন স্বর্গের উদ্দেশ্যে। তোমার ঝর্ণার নীল স্রোতেভাসিয়ে নিয়েছো এই রূঢ় বস্তু পৃথিবী হতে গূঢ় স্বপ্নে, আর দূরদূরান্তর কল্পনার দিকে।’
আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘আমার কবিতা’য় তাঁর অমোঘআহŸানÑ‘তা’হলে জ্যোৎ¯œা তুমি নেমে এসো আমার খাতায়;রাত্রি নামো কালো-কালো অজস্র অক্ষরে।জ্যোৎ¯œা আর রাত্রি নামো হৃদয়ে ও চোখের পাতায়।রাত্রি আর জ্যোৎ¯œা জ্বালো কবিতার রক্তে, কণ্ঠস্বরে।’মহান স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পরস্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশেরসাহিত্য-সংস্কৃতিতে এক নবতর জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাসাহিত্যের উৎকর্ষের ক্ষেত্রে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। সাহিত্য ওআধুনিক কবিতার বিপ্লব সাধিত হয়। আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন কবিতার বিপ্লবের অন্যতম সৈনিক। পশ্চিম বাংলায় জন্মগ্রহণকরে থাকলেও তিনি চিরকাল বাংলাদেশকেই সবচেয়ে বেশিভালোবেসেছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি, মাটি,মানুষ, প্রাণীকুল, বৃক্ষ ও তরুলতার সাথে মেশানো তাঁর পুরো অবয়ব।কবিতায় বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়েউচ্চারণ করেন :‘নারকেল সবুজ পাতার বালির ঢাকা চাঁদের সোনালী কামাননিঃশব্দ ওঙ্কারে গর্জে উঠে তুমুল জ্যোৎ¯œা ছুড়ে মারেএই চলে সারারাতজ্যোৎ¯œায় তমসায় বাদানুবাদ গৃহযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে যায়।’অসাধারণ সাবলীলতা ও শুদ্ধতর নক্ষত্রের সুন্দর সুন্দর উপমা জ্বলে উঠেছে তাঁর কবিতার পরতে পরতে। অনেকে মনে করতে পারেন, আবদুল মান্নানসৈয়দ তাঁর গবেষণাকর্মে যে পরিমাণ সময় দিয়েছেন, কবিতার ক্ষেত্রেততটা গুরুত্ব দেননি! এই অনুযোগটি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায়না। কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলা যায়, প্রথমে তিনি কবি, তারপর গবেষক ওসব্যসাচী লেখক। কবিতার মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম তিনি সাহিত্য জগতে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রথম যে বইটি প্রকাশিতহয়, সেটিও ছিল কবিতার। তাঁর কাব্যগ্রন্থসংখ্যা খুব একটা কমনয়। বেশ ঝরঝরে বৈচিত্র্য মাখিয়ে কবিতা লিখেছেন তিনি।তাঁর কবিতার প্রতীতিতে বিশ্বাসবোধ ও বিশ্বাসযোগ্যতার সর্ব বিস্তারী মন্ময়তা আছে। পাঠককে জাগিয়ে তোলার ব্যঞ্জনা আছে। সান্নিধ্যের আকুলতায় সুনিবিড় ছন্দময়তার সৌন্দর্য আছে। কবিতার সমগ্র জীবনের জায়মান নিয়মের আলোতে তাঁরমেধা, মনন ও সৃজনশীলতার উদ্ভাবনী শক্তি অত্যুজ্জ্বল সাহিত্যা দর্শের চিরকালীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে রেখেছে; যা কখনো বাংলা সাহিত্য থেকে মুছে যাওয়ার নয়। জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাতে তিনি অসীম ধৈর্য ও একাগ্রতার পরিচয় দিয়েছেন।
ব্যক্তিগত ভাবে কর্মের প্রতি একাগ্রতা, নিষ্ঠাবোধ, আচার-ব্যবহার,বিনয় ও ভদ্রতায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। কখনো কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে সাহিত্যের জায়গা থেকে দূরে থাকেননি। অনুপম সৌন্দর্যে প্রতি বিম্বিত এক আশ্চর্যতম সম্মোহনী শক্তি ছিল চোখে-মুখে। বর্ণাঢ্য জীবনাচারের মধ্যে তাঁর কবিতা ওসাহিত্য কর্ম চিরকাল অনুপম বৈদগ্ধ্যের অনুষঙ্গী হয়ে থাকবে।সবকিছুর ঊর্ধ্বে তিনি নিবিড়ভাবে সাহিত্যের মধ্যেই আত্মমগ্ন ছিলেন। তাঁর সাহিত্যের স্বরূপ সন্ধানে অপরিমেয় সম্ভাবনার যে অনন্ত সমাহার আছে; তার অনুসন্ধান এবং তাঁর সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে পারলে ক্রমে ক্রমে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বাংলা সাহিত্যের আকাশে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের সাহিত্য চিরকাল দীপ্তিমান ও সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তিনি চির অনির্বাণ।
(৫ সেপ্টেম্বর কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে প্রবন্ধটি লিখিত)