বিদ্যুত রঞ্জন দে
আদিকাল থেকে বিশ্বে যে সমস্ত সমাজ ব্যবস্থা চলে আসছে তার মধ্যে ১৯১৭ সালে অক্টোবর মাসে রাশিয়াতে যে শ্রেণী-বিবর্জিত সমাজ গড়ে উঠেছিল, সমাজবিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকদের মতে তা ছিল সর্বোতকৃস্ট সমাজ। দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে যে শোষণ চলছিল তার মূল উত্পাঠনের আদর্শিক কর্মসূচি নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল অক্টোবর বিপ্লব।এই বিপ্লবের সুফল যেটুকু ভোগ করেছে রাশিয়ার জনগণ তার চেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে বিশ্বের সাধারণ মানুষ ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবতার শত্রু ফ্যাসিবাদকে রুখে বিশ্বকে নিরাপদ করতে সোভিয়েট রাশিয়া উত্সর্গ করেছিল সামরিক ও বেসামরিক মিলে দুই কোটি সত্তর লক্ষ প্রাণ। আর এটা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র দেশ মাতৃকাকে ভালোবেসে এবং অক্টোবর বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে জীবন উত্সর্গ করার মন্ত্রে দীক্ষাগ্রহনের ফলে।বর্তমান উন্নত বিশ্বে যে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় বা বেষ্টনী তৈরি হয়েছে তার মূলে অক্টোবর বিপ্লবের আদর্শ এবং পুঁজিবাদী বিশ্বে শ্রমিক আন্দোলনের আতঙ্ক । সোভিয়েট ইউনিয়ন বিশ্ববাসীকে আত্মনির্ভরশীল উন্নয়ন ও তার পথ হিসেবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা পদ্ধতির উপহার দেয় এবং উন্নত পুঁজিবাদী দেশসমূহের আগেই নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করে। বিশ্বে প্রথম মহাশূন্য অভিযান শুরু করে রাশিয়া স্পুটনিক মহাশূন্যযানের মাধ্যমে এবং প্রথম মহিলা মহাশূন্যচারী ভেলেন্তিনা তেরেসকোভা।
দীর্ঘ ৭০ বছর বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রে যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা ছিল তা ১৯৯১ সালে পশ্চাদগমনের ফলে বিশ্ব এখন পুঁজিবাদী এক কেন্দ্রিক বিশ্বে পরিনত হয়েছে এবং এর একচ্ছত্র নেতৃত্ব দিছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র । যদিও চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা এবং উত্তর কোরিয়াতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতাকা ঝুলছে কিন্তু আগের মতো বিশ্ব বিবেক সোচ্চার হচ্ছে না কারণ এখনও এই সমস্ত দেশে সম্পূর্ণরূপে শোষণ বন্ধ হয়নি এবং সোভিয়েট রাশিয়ার মতো চীন তাদের অঙ্গীকারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পারছে বলে জনগনের আস্থা স্থাপিত হয়নি ।সোভিয়েট ইউনিয়নের অঙ্গীকার ছিল ফ্যাসিবাদকে রুখা, বিশ্বের অনুন্নত দেশের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে সমর্থন দেয়া এবং বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধংদেহী কার্যক্রমকে প্রতিহত করা। এর বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে কিউবা সংকট এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে রাশিয়ার সমর্থন, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ ও মধ্য প্রাচ্যের অনেক দেশকে অতি অল্প সুদে ঋণ প্রদান, আফ্রো-এশীয় ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকারের সংগ্রামে সমর্থন যোগানো। পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশকে খাদ্য সাহায্য দেওয়া। যেহেতু ১৯৯১ সালে ইউ এস এস আর (USSR) ভেঙ্গে গেছে এবং রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র অনুপস্থিত তাই বলে বিশ্বে এর প্রভাব মোটেই ম্লান হয়নি।
বর্তমান বিশ্বে জনতার কন্ঠ সোচ্চার হচ্ছে সম্পদের বৈষম্য দূরীকরণের কর্মসূচি নিয়ে পুঁজিবাদের দেওয়াল ভাঙ্গতে ।২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর “অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট” নামে যে আন্দোলন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য রাষ্ট্রে সংগঠিত হয় তার মূল দাবি ছিল ১% লোকের কাছে ৯৯% লোকের সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে যাওয়া সম্পদের সমবন্টন করা। এছাড়াও গত এবং এই বছরের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের পদপ্রার্থী সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স আমেরিকায় গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছেন এবং এর সমর্থনে ব্যাপক সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন যাবৎ আমেরিকায় যে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন চলছে তার প্রমাণ ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর ৭০০ বিলিয়ন ডলারের বেইল আউট যার মাধ্যমে বেসরকারী বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা । বর্তমান করোনা ভাইরাস কালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ২.২ ট্রিলিয়ন ডলার অনুদান দেয়ার জন্য “বেইল আউট” করেছে কিন্তু জনসাধারণের অভিযোগ এই অনুদান বন্টনে যাদেরকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা ছিল, তাদের চেয়ে ধনী ব্যক্তি ও সম্বৃদ্ধশালী কর্পোরেশন বেশি উপকৃত হচ্ছে ।ফলে পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জনগনের মনে সঞ্চার হচ্ছে ক্ষোভ এবং জাগ্রত হচ্ছে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের মাধ্যমে সম্পদের সমবন্টনের আকাংখা।
বর্তমান বিশ্বে করোনা ভাইরাসের কারণে যে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেবে তাতে সামাজিক নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে এবং মুক্ত বাজার অর্থনৈতিক তথ্যের প্রয়োগে এর সমাধান হবে না, এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন হবে সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বন্টন। সাময়িক পরিস্থিতি সামাল দিতে “বেইল আউট” পদ্ধতি কার্যকরী হলেও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সমাধানে সুনির্দিস্ট কর্মসূচি প্রনয়ন করতে হবে, যাতে রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ব্যক্তি বা বৃহৎ কর্পোরেশনের নয়। অগ্রসরমান পুঁজিবাদী বিশ্ব বোধ হয় আর বেশি চাপ নিতে পারবে না কারণ তার গর্ভে যে সমাজতন্ত্রের বীজ লালিত হচ্ছে তা বাহির হয়ে আসবে। সমাজতন্ত্র অকার্যকর ১৯৯১ সালে শুধু রাশিয়াতেই হয়নি, এর আগেও ১৮৭১ সালে ফ্রান্সে “প্যারী কমিউন” দুই মাস দশ দিন কার্যকর ছিল। আবারও বিশ্বে যে এমন একটি শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নাই।
প্রযুক্তির নতুন আবিষ্কারের ফলে বিশ্বের অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক গতি প্রকৃতি পরিবর্তিত হচ্ছে । বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কম্পুটার-ভিত্তিক যে “ডিজিটাল বিপ্লব” সংগঠিত হয়েছে তা সারা বিশ্বকে একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে এসেছে ফলে অতি সহজে মানুষ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ঘরে বসে সংগ্রহ করে, দলবদ্ধভাবে অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠ সোচ্চার করতে পারছে ।আগামীতে আসছে “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা” বা “আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স” যার মাধ্যমে যন্ত্রকে অপরিমেয় তথ্য দ্বারা সম্বৃদ্ধ করে সমাজ প্রগতির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে | বিশ্বে একটি নতুন সমাজ গড়ার কাজে এ সমস্ত প্রযুক্তি সহায়ক হবে যদি এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
সবশেষে যে উক্তিটি করতে হয়, তা হলো অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে রাশিয়ার মতো একটি ঘুনেধরা সামন্তবাদী রাষ্ট্র একটি উন্নত বিশ্বের সমপর্যায়ের শিল্পোন্নত দেশে পরিনত হতে পারে। এর পিছনে যে আদর্শটি কজ করেছে তার নাম হলো সমাজতন্ত্র। ভবিষ্যতে শোষনহীন সমাজ যে গড়ে উঠবে তাতে কোন দ্বিধা বা সন্দেহ নাই কিন্তু তার রূপরেখা হুবুহু আগের মতো হবে তা বলা মুশকিল। বিশ্বের যে কোন মানুষই শোষনের যাতাকলে পিষ্ঠ হতে চায় না কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বন্ধন তাকে আটকে রাখে ।অক্টোবর বিপ্লব সেই বাঁধন ভাঙ্গার মন্ত্র শিখিয়েছে ভবিষ্যতে নতুন সমাজ গড়তে কিভাবে এগিয়ে যেতে হয় ।বিশ্ব মানবতার কন্ঠ জাগ্রত হউক এবং অক্টোবর বিপ্লব পথ দেখাক এটাই হোক প্রত্যাশা।
ছবি : উইকিপিডিয়া