কতিপয় প্রস্তাব
হাসান মাহমুদ
দুনিয়ায় সর্বাপেক্ষা ভারী পিতামাতার কাঁধে সন্তানের লাশ। নুসরাত জাহান রাফি’র পিতা কন্যার লাশ শুধু বহনই করেননি, তার জানাজাও পড়িয়েছেন। আমিও এক কন্যার পিতা, খবরটায় প্রথমে শিউরে উঠেছিলাম। পরে দেখি দগ্ধমৃত মেয়েটা শুধু আমারই নয় সারা জাতির কন্যা প্রতিমা হয়ে উঠেছে। অন্যায়ের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করে নোবেল পুরস্কার পায় মাথায় বুলেট খাওয়া মালালা ইউসুফজাই আর ‘ইসলামিক স্টেট’-এর জিহাদীদের দ্বারা না জানি কত শতবার গণধর্ষিতা নাদিয়া মুরাদ। আর অন্যায়ের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করে আমাদের দুর্দান্ত প্রতিবাদীনী আগুনে পুড়ে মরে। ছোট্ট এক কিশোরী ক্রমাগত চিৎকার করে যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছে, দোর্দÐপ্রতাপ অধ্যক্ষের মুখে মামলা ছুঁড়ে মেরেছে, বাংলাদেশে এটা চিন্তা করা যায়!
প্রচÐ ঝাঁকি খেয়েছে বাংলাদেশ। অনেক দিক দিয়ে জাতি এগিয়ে যাবার পরেও বিচারহীনতার ভয়ংকর দানব দেশকে গ্রাস করেছে। যাহোক, অভিযোগ তো করাই যায়, করা হচ্ছেও। কিন্তু তার চেয়ে অনেক জরুরী অনতিবিলম্বে এই হিংস্রতা বন্ধ করার পদ্ধতি বের করে প্রয়োগ করা। দুটো পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই নেয়া হয়েছে:-
(ক) সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের স্বার্থে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনের শিকার নারী বা শিশুদের জবানবন্দি নেওয়ার দায়িত্ব নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।
(খ) থানায় রাফি›র বুকভাঙা ভিডিও দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে জাতি। ওই ভিডিও ধারণের জন্য ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ব্যারিষ্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। এজন্য এবং দেশের মঙ্গলের জন্য তাঁর ক্রমাগত অন্যান্য প্রচেষ্টার জন্য অজস্র অভিনন্দন।
রাফি হত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রত্যেককে অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতেই হবে। নাহলে সরকার, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার ওপর দেশবাসীর ইতোমধ্যেই ক্ষতবিক্ষত আস্থা চিরকালের মতো উঠে যাবে। এই দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জাতি হাঁসফাঁস করছে। কবি নির্মলেন্দু গুন অনশনের কথা বলেছেন, আইনজীবীরা ঘোষণা দিয়েছেন তাঁরা ক্রিমিন্যালদের পক্ষে লড়বেন না। ফেসবুকে সাইক্লোন চলছে, অভিযুক্ত ওসি›র বিচারের দাবীতে ইন্টারনেটে সিগনেচার ক্যাম্পেইন শুরু হয়েছে। সবাই মিলে অন্যান্য প্রস্তাব ও আলোচনা করলে পথ একটা বেরিয়ে আসবেই।
আমার কিছু প্রস্তাবঃ
১. শিক্ষার্থী অভিভাবক সবার জন্য প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে কপি করে শিক্ষাবোর্ড ও মাদ্রাসা বোর্ডের প্রতি অন লাইন অভিযোগের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে অপরাধপ্রবণ শিক্ষকেরা হুঁশিয়ার হতে বাধ্য হবে। এটা থাকলে রাফি’কে থানায় গিয়ে ওসি মোয়াজ্জেমের হাতে নির্যাতিতা অপমানিতা হতে হতোনা।
২. ওই মাদ্রাসার সামনের রাস্তার নাম রাখা হোক “নুসরাত জাহান রাফি সড়ক”। নাম-ফলকটা সবার চোখের সামনে ধরা থাকবে, আমাদের বিস্মৃতিপ্রবণ জাতিকে চিরকাল রাফি›র প্রতিবাদ আত্মদান এবং ওই ক্রিমিন্যালদের কথা মনে করিয়ে দেবে।
৩. ধর্ষণের মহামারীতে আক্রান্ত বাংলাদেশ, ভয়াবহভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে জাতির নারীরা। ধর্ষণের জন্য আলাদা ট্রাইবুনাল গঠনের দাবীতে ঢাকায় মিছিল হয়েছে। সেটা করতে হবে এবং শুধুমাত্র ধর্ষণের তদন্তের জন্য নারী-প্রধান সিভিল কমিটি গঠন করতে হবে। যেহেতু মাদ্রাসা একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান তাই কমিটিতে মানবাধিকার কর্মী, আইনবিদ, শিক্ষক ইত্যাদির সাথে একজন আলেম-ইমাম থাকতে হবে।
৪. প্রমাণিত ধর্ষণের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদÐ, এ আইন বানিয়ে কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে।
৫. কোন শিক্ষক কোনো ছাত্র বা ছাত্রীকে শিক্ষায়তনের ভেতরে কোনো কক্ষে একা দেখা করতে বলতে পারবেন না, এ আইন বানিয়ে কঠোরভাবে তা প্রয়োগ করতে হবে। স্মর্তব্য, অধ্যক্ষ সিরাজের অফিসে ছাত্রীদেরকে একা দেখা করতে হত।
৬. ভ্রাম্যমান আদালতের আদলে নারী-প্রধান ্রভ্রাম্যমান শিক্ষায়তন পরিদর্শন কমিটিগ্ধ গঠন করতে হবে। মাদ্রাসা স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান তাই এতে মানবাধিকার কর্মী, আইনবিদ, শিক্ষক ইত্যাদির সাথে একজন আলেম-ইমাম থাকতে হবে। এই কমিটি দেশের যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগে জানান না দিয়ে ঝটিকা পরিদর্শন করতে পারবে ও সদস্যেরা একত্রে যে কারো সাথে একান্তে কথা বলার ক্ষমতা রাখবেন।
৭. যেসব মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ছাত্র-পেটানোর ও বলাৎকারের অভিযোগ আছে সেগুলোর তদন্ত ও সিসি ক্যামেরা বসানো বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৮. গণসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। মাদ্রাসায় এ ধরণের সমস্যার ওপরে শাহাদৎ রাসেল নির্মিত বাংলা শর্ট ফিল্ম ‘কালার অফ চাইল্ডহুডগ্ধ আমেরিকার আটলান্টায় ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক শর্ট ফিল্মগ্ধ পুরস্কার পেয়েছে। এটা, এবং এরকম আরো ছোট ছোট মুভি বানিয়ে টিভি সহ যেভাবে সম্ভব ব্যাপক প্রচার করতে হবে। ভারতের চিত্রনায়ক আমির খানের মতো বাচ্চাদের নিয়ে কয়েক মিনিটের ফিল্ম বানিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে তিনি ছবি এঁকে বাচ্চাদের বুঝিয়েছেন তাদের ওপর যৌন নির্যাতন কি এবং সেক্ষেত্রে কি করতে হবে।
৯. বিশাল দায়িত্ব আছে আলেম সমাজের। অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন কিছু ইমাম, তাঁদের ধন্যবাদ। কিন্তু আমরা তাঁদের কাছ থেকে আরো বেশী আশা করি। বহুদিন থেকেই মাদ্রাসায় শিক্ষক দ্বারা ধর্ষণ ও ছাত্র-প্রহারের খবর আসছে। আমরা দেখতে চাই তাঁরা বক্তৃতায় এর নিন্দা করা ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে বা এই বিষয়ের ওপর কমিটি বানিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাবেন, সবার সাথে কথা বলবেন। এতে ভিকটিমের শক্তি-সাহস বাড়বে, অপরাধীর মনোবল হ্রাস পাবে, প্রশাসনের ওপরে সঠিক তদন্তের চাপ সৃষ্টি হবে ও পরের সম্ভাব্য অপরাধীর প্রতিবন্ধক হবে।
সিরাজুদ্দৌলার শক্তিগুলো হলঃ
(১) সমাজে উচ্চ অবস্থান, (২) টাকার শক্তি (অজস্র টাকা সে আত্মসাৎ করেছে, গ্রেপ্তারের পরেই তার স্ত্রী একসাথে আঠারো লক্ষ টাকা তুলেছে ব্যাংক থেকে), (৩) থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, (৪) ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম (৫) সরকারী কর্মকর্তা (নীচে তিন শিক্ষকের কাহিনী দেখুন), (৬) মাদ্রাসা শিক্ষক আফছার আহমেদ, (৭) ক্যাডার শামীম, জাবেদ, জোবায়ের, আহমেদ, পপি ইত্যাদি। (৮) পক্ষান্তরে, রাফি›র পরিবারের সামাজিক ও সিরাজুদ্দৌলার তুলনায় আর্থিক দুর্বলতা সুস্পষ্ট।
দেশের সর্বত্র অপরাধী-চক্রের এটাই মোটামুটি কমন টেমপ্লেট। বহু জায়গায় বহু অপরাধের ক্ষেত্রে ওপরের ১ থেকে ৮ পর্য্যন্ত শুধু নামগুলো বদলে দিলেই চিত্রগুলো মোটামুটি মিলে যাবে। বহু মাথা বিশিষ্ট এই প্রকাÐ হাইড্রা দানবের সাথে কিভাবে পেরে উঠবে সাধারণ মানুষ? জামিন পেয়ে ধর্ষক ধর্ষিতাকে আবার ধর্ষণ করে খুন করে ফেলে গেছে, এমন বীভৎস ঘটানোও তো আমরা দেখেছি।
অপরাধী অপরাধ করে। কিন্তু পুলিশ যখন অপরাধ করে এবং শিক্ষক, বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যখন ধর্ষক হয়ে ওঠে তখন পায়ের নীচে আর মাটি থাকেনা। বেরিয়ে আসছে সিরাজুদ্দৌলার অপরাধ-নামা। বহু বছর ধরে ছাত্রী-নির্যাতন, ছাত্র-বলাৎকার, টাকা আত্মসাৎ ইত্যাদি ক্রাইমের অপ্রতিহত ক্রিমিন্যাল সে। দুবছর আগে সাহস করে তার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে আরেক ছাত্রী-নির্যাতনের অভিযোগ করেছিলেন ওই মাদ্রাসার তিন শিক্ষক। শেষতক এক ভুতুড়ে কাল্পনিক ঘটনার কারণ দর্শাওগ্ধ হুমকি-নোটিসের মুখে নাকে খৎ খেয়ে বুকভাঙা বেদনায় চুপ করে গেছেন তাঁরা, এখন টেলিভিশনে মুখ খুলছেন।
তিনটে ব্যাপার লক্ষ্যনীয়। এক, – প্রধানমন্ত্রীকে দেশের জুতো সেলাই থেকে চÐীপাঠগ্ধ সবই করতে হবে কেন? তাছাড়া, কোনো এক ব্যক্তির ওপরে এতটা চাপ যে কোনো দেশের জন্য বিপজ্জনক। দুই, – ক’দিনের মধ্যেই পুলিশ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পলাতক অপরাধীদের ধরেছে। অর্থাৎ সে দক্ষতা তাদের আছে। কিন্তু আগের বহু হতভাগীদের ক্ষেত্রে খুনী-ধর্ষক ধরা পড়েনি কারণ ওগুলোতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যত তর্জনী ছিলনা, এক্ষেত্রে আছে। তিন, – একের পর এক অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদেরকে ‘ক্লোজড’ বা ‘প্রত্যাহার’ করাটা কোনো সমাধানই নয়, সমাধান হল তদন্তে অপরাধী প্রমাণিত হলে শাস্তি দেয়া। পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেটা করলে অপরাধ-প্রবণ পুলিশ অফিসারেরা সাবধান হবে এবং পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
এই মেয়েকে আমাদের দরকার ছিল। ৭৫-৮০% অঙ্গার দেহ নিয়ে যে মেয়ে চিৎকার করতে পারেÑ ‘আমি সারা বাংলাদেশের কাছে বলবো, সারা পৃথিবীর কাছে বলবো এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য’ – সেই মেয়েকে আমাদের বড়ো বেশী দরকার ছিল।
এমন মেয়ে আবার কবে আসবে কে জানে !
মাটির ভুবন পরে, মাটির ভুবন ভরে,
লাশ হয়ে আছে পড়ে, অমূল্য রতন,
নিসর্গের লক্ষ তারা, সিক্ত চোখে বাক্য হারা,
দেখে দেখে হয় সারা, নিসর্গের ধন।
রংধনু রং যত, লক্ষ ফুলের মত,
ওই মুখে শত শত, খেলা করে তার,
কোথা রাখি কোথা রাখি ! অমিয় সুখের পাখী,
বুকের পাঁজরে ঢাকি, কন্যা আমার !