স্মৃতিতে অম্লান অগ্রজ
শেখ শাহনওয়াজ
তখনকার বাগেরহাট মহাকুমার চিতলমারীর পাশে, পাটরপাড়া গ্রামের বিশ্বাসবাড়ীর অপরূপ সুন্দরী দু’বোন- সবুরোন্নেসা ও হাজেরা বেগম। সবুরোন্নেসার বিয়ে হয় গোপালগঞ্জের বর্ণি গ্রামের গফুর মোল্লার সঙ্গে, আর ছোটবোন হাজেরা বেগমের বিয়ে হল মোল্লাহাটের শৈলদাহ গ্রামের ডাক্তার হাসমত আলী সিকদারের সাথে।
তখনকার দিনে নদী-নালা-খালের বাংলায় যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল নৌকা। দূরে কোথাও আত্মীয় বাড়ীতে যেতে হলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হত- এক মাল্লার ছাওনি দেওয়া পানসী নৌকা। আমাদের স্থানীয় ভাষায় বলে টাবুরে। এই নৌকায় চার-পাঁচ জন শুয়ে বসে চলাচল করা যায়।
সবুরোন্নেসা একবার- তখনও পর্যন্ত একমাত্র কন্যা সালেহা-সংক্ষেপে সালুকে নিয়ে পানসীতে চড়ে বাপের বাড়ী নাইওরে যাচ্ছিলেন। নৌকটি বর্ণির বাওড় পার হয়ে বাইগার নদীতে পড়ে। এই বাইগার নদীর পাড়ের টুংগীপাড়া গ্রামে বঙ্গবন্ধুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। নৌকোটি টুংগীপাড়ার ভিতর দিয়ে খাল পেরিয়ে পাশের গ্রাম ও মোকাম পাটগাতীতে বড় নদী মধুমতীতে প্রবেশ করে। ‘ও রূপালী নদীরে রূপ দেইখ্যা তোর হইয়াছি পাগল’ গানের বাস্তব রূপ ধারণ করেছে মধুমতী নদীর এই শেষাংশ। পাটগাতী বাজারের বিপরীতে চিংগড়ী ছাড়িয়ে অল্প ভাটিতে বাদিক দিয়ে ডুমুরিয়া, তারাইল বাজার হয়ে কোটালীপাড়ার দিকে বয়ে গেছে শান্ত- নিস্তরঙ্গ কালো পানির ঘাগোর নদী। এই নদীর তীরে দিঘীরপাড় গ্রামে জন্ম নেন জাঁদরেল সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতা নির্মল সেন। যিনি অনিকেত বা গৃহহীন ছদ্মনামের কলাম লেখক হিসাবে সমধিক পরিচিত। দিঘীরপাড়ের দূরত্ব টুংগিপাড়া থেকে মাত্র কয়েক মাইল। নির্মল সেনের কাকা কার্তিক সেন ছিলেন পাটগাতী বাজারের নামকরা আবাসিক ডাক্তার।
মধুমতি খানিক চলতে চলতে ডান দিকে রাজনগর আর বাঁয়ে বাঁশবাড়িয়া বাজার রেখে শেষ হয় দক্ষিণে মাটিভাংগা বাজারে। পাশের গ্রাম মাহমুদকান্দায় রাজনীতিক মতিয়া চৌধুরীর পিত্রালয়। মধুমতি যেখানে শেষ, সেখান থেকে শুরু দুই নদীর। বাঁদিক দিয়ে পিরোজপুরের দিকে চলে গেছে খরস্রোতা নদী তালতলা। ডানদিকে চলে গেছে অপেক্ষাকৃত শান্ত স্বভাবের বলেশ্বর নদী। সবুরোন্নেসার পানসী চলে যাবে বলেশ্বর ধরে কিছুদূর এগোনোর পর বাবুগঞ্জ বাজারের পাশের খাল দিয়ে চিতলমারীর দিকে। পাশেই পাটরপাড়া। সবুরোন্নেসার এই যাত্রা পথে মধুমতি পাড়ের শৈলদাহ থেকে তাদের সঙ্গী হলেন ডাক্তার হাসমত আলী। তিনি তখন চিতলমারী বাজারে ডাক্তারী করতেন। পানসী নৌকাটি ভাটির দিকে এগুতে থাকে। মধুমতির ছোট ছোট ঢেউয়ের মৃদু দোলায় তিন-চার বছরের শিশু সালেহা একসময় ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত শিশুটিকে কি সুন্দর লাগছিল! ডাক্তার হাসমত আলী ভাবছিলেন, এই মেয়েটি বড় হলে তার পরম আদরের ভাগ্নে আলতাফের সংগে বিয়ে হলে কেমন হবে! সালেহা একসময় বড় হয়ে ওঠেন। সুদর্শন আলতাফ মিয়া লেখাপড়া শেষ করে ঢোকেন পুলিশ বিভাগে। হাসমত আলী সিকদারের উদ্যোগে পরে আলতাফ-সালেহার বিয়ে হয়। এই দম্পতির প্রথম সন্তান আবুল হোসেন মিয়াঁ টুকু- যিনি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বহুল পঠিত, বহুল আলোচিত ও বহুল উদ্ধৃত কবি আবুল হাসান- যাকে নিয়ে আমাদের আজকের এই আয়োজন।
উল্লেখ্য, আমার নানার নাম ডাক্তার হাসমত আলী সিকদার আর নানির নাম হাজেরা বেগম। আমার মায়ের খালত বোন সালু খালাম্মা, আর আমার মায়ের ফুফাত ভাই আলতাফ মামা। কবি আবুল হাসান আমার খালত ও মামাত ভাই। অর্থাৎ দু’দিক দিয়ে আমার ভাই। সেজন্য তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ছিল বেশ পোক্ত।
কবি আবুল হাসানদের বাড়ী মধুমতির পূর্ব পাড়ে পিরোজপুরের ঝনঝনিয়া গ্রামে। আমাদের বাড়ী পশ্চিম পাড়ে বাগেরহাটে, বৃহত্তর খুলনায়। পূর্ব পাড়ে একটা বড় খাল দিয়ে বরিশাল ও ফরিদপুর জেলার বিভাজন। আমাদের জায়গাটা এমন- ছোটবেলায় বড়দের মুখে শুনতাম, একটা বিড়ি টেনে তিন জেলায় ঘুরে আসা যায়।
কবি আবুল হাসানের শৈশব, কৈশর কেটেছে গোপালগঞ্জের-এখনকার টুংগিপাড়া উপজেলাধীন বর্ণির মামা বাড়িতে। তার বাবার পুলিশের বদলির চাকুরীর বেশীরভাগ সময় কেটেছে ঢাকার মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদীর মনোহরদি, রায়পুরা প্রভৃতি থানায়। লেখাপড়ার জন্যই বড়ছেলেকে নানা বাড়িতে রেখে দেওয়া হয়। তার বাবা কিছুদিন ছিলেন সূত্রাপুর ও লালবাগ থানায়। তখন তাকে আরমানিটোলা সরকারী হাই স্কুলে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকেই তিনি ১৯৬৩ সালে মেট্রিক উত্তীর্ণ হন।
আলতাফ দারোগা, মানে আমাদের আলতাফ মামা ছিলেন জাগতিক ব্যাপারে বেশ উদাসীন এবং অন্তর্গত বাউল। আবুল হাসান ‘রাজা যায় রাজা আসে’ বইয়ের ‘চামেলী হাতে নিন্ম মানের মানুষ’ কবিতায় তার বাবার প্রকৃতি তুলে ধরেছেন। চাকুরী থেকে অবসর নিয়ে আলতাফ মামা গ্রামে এসে স্থায়ী হয়েছিলেন। তার অন্যান্য ছেলেমেয়েরা সবাই গ্রামের স্কুলে পড়েছে। এবং তারা সবাই ছিল মেধাবী।
আগেই বলেছি, আবুল হাসান শৈশব কৈশরে স্কুলে পড়তেন নানা বাড়ি থেকে। তার সঙ্গে যে আমাদের খুব দেখা হত- তা নয়। আমি তাকে ডাকতাম টুকু ভাইজান বলে। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি একবার আমার নানা বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তখনই তার মেধার খবর আত্মীয়দের মধ্যে ছড়াতে শুরু করে। আমরা মুগ্ধ হয়ে তার হাতের লেখা ও আঁকিবুঁকি দেখতাম।
মেট্রিকুলেশনের পরে আবুল হাসান ভর্তি হলেন বরিশাল বিএম কলেজে। তখন আরেকবার আসেন আমার নানা বাড়ি। কি সুদর্শন যুবক! আমরা শুনতে পাই বরিশালে তিনি এক সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তার নাম রিজিয়া। এর চেয়ে বেশী কিছু আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে মনে হয় বরিশাল শহরের বাসিন্দা, কবি ইকবাল হাসান কিছু তথ্য দিতে পারবেন।
ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর আবুল হাসান ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। থাকেন হলে। ততদিনে তার বাবা সংসার নিয়ে গ্রামে চলে এসেছেন। আবুল হাসানের মুক্ত স্বাধীন জীবন। তদারকি করবার কেউ নেই ধারে কাছে। এই সময়েই তিনি কবিতার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করছিলেন। পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে তার লেখা বের হতে শুরু করলো। কিন্তু অচিরেই তার জীবনের ছন্দপতন হল। প্রয়োজনীয় ক্লাস উপস্থিতি না থাকার কারণে সাবসিডিয়ারি পরীক্ষা দেয়া যাচ্ছে না। জাঁদরেল সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন ইংরেজি বিভাগের প্রধান। চেঁচামেচি করেও কাজ হল না। এখানেই শেষ হয়ে গেল আবুল হাসানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন। আর এই সঙ্গে শুরু হল আত্মীয়-পরিজন বিহীন ঢাকা শহরে বোহেমিয়ান জীবন। গ্রামে থাকা পরিবারের সাথে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিছিন্ন হয়ে যায়। থাকার নির্দিষ্ট জায়গা নেই। বন্ধু নির্মলেন্দু গুনসহ মসজিদ, পরিত্যক্ত বাসে রাত কাটাতে হয়। আমরা দূর থেকে শুধু খবর পাই টুকু ভাইজান কবিতা লেখেন। কলেজে পড়ার সময়েই আমার নিজেরও সাহিত্য সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। যদিও কবিতা-গল্প লিখি না বা পারি না। খুলনা সিটি কলেজের বাংলার অধ্যাপক, আমার শিক্ষক ইজাজ হোসেন প্রথম আমাকে ঢাকার একটি সাহিত্য সংকলনে মুদ্রিত আবুল হাসানের একটি কবিতা ও প্রচ্ছদে তার ছবি দেখান।
স্বাধীনতা লাভের পর ঢাকায় যাওয়ার তাগিদ অনুভব করছিলাম। প্রধান কারণ, টুকু ভাইজানের সাথে দেখা করা। গেলাম ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী মাসে। দ্বিতীয় বারের মত ঢাকায় যাওয়া। এর আগে ১৯৬৬ সালে অবশ্য একবার গিয়েছিলাম। যাহোক, আবুল হাসান তখন সদ্য প্রকাশিত দৈনিক জনপদের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতেন। অফিস বাংলাবাজারে এসোসিয়েট প্রেসের দোতলায়। একদিন সকালে হাজির হলাম। আমাকে দেখে খুশী হলেন। পরে আরেকদিন কাজ শেষে আমাকে নিয়ে গুলিস্তানের দিকে রওনা হলেন। পথে ঢুকলেন মরণ চাঁদে কিছু খেতে। ওখানে আগেই বসেছিলেন জগন্নাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপক আবদুল্লা আবু সাইদ ও আব্দুল মান্নান সৈয়দ। অধ্যাপক আবু সাইদ তখন উঁচুমানের সাহিত্য সংকলন ‘কণ্ঠস্বর’ সম্পাদনা করতেন। তিনি দৈনিক জনপদে আবুল হাসানের লেখার প্রশংসা করলেন। আমাদের আপ্যায়িতও করলেন।
১৯৭৩ সালের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হই। ঢাকায় আসি মূলত আবুল হাসানের টানে। খুলনা-যশোহর অঞ্চলের উচ্চশিক্ষার্থীরা যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধার জন্য সাধারণত রাজশহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। যা হোক, আমি থাকি জহুরুল হক হলে। সাংবাদিকতা বিভাগের ক্লাস হত তখন সন্ধ্যায়। দিনে কোন কাজ নেই, শুধুই ঘোরাফেরা। আবুল হাসান তখন কাজ করেন সাপ্তাহিক গণবাংলায়। হোটেল ইন্টারকনের উল্টা দিকের ডিআইটি মার্কেটের পিছনে ইংরেজি দৈনিক পিপল ও সাপ্তাহিক গণবাংলার অফিস ছিল। এগুলোর মালিক সম্পাদক ছিলেন আবিদুর রহমান। এই ভদ্রলোকের বাংলাদেশে তখন রমরমা অবস্থা। যা হোক, প্রায়ই গণবাংলার অফিসে গিয়ে বসে থাকি। ভাইয়ের সৌজন্যে দুপুরের খাওয়াটাও হয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে একটা অভিজ্ঞতার কথা বলা যায়। ডিআইটি মার্কেটের নিচুতলায় আপ্যায়ন বা এই জাতীয় নামে একটা ভালো রেস্তোরা ছিল। সেখানে আবুল হাসানের সংগে আড্ডা দিতে প্রায়ই আসতেন সোভিয়েত কালচারাল সেন্টারের প্রধান অনুবাদক কবি শহীদ কাদরী। আর আসতেন সদ্য কলকাতা ফেরত বেকার, কবি বেলাল চৌধুরী। তখন কেউ বিয়ে করে সংসারী হননি। শহীদ ভাই ছিলেন বৈঠ্কী মেজাজের কৌতুকপ্রিয় মানুষ। সাপ্তাহিক বিচিত্রা তখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। চমৎকার সব বিষয় নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনী রচিত হয়। এক সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনী ছিল ‘মেয়েদের চোখে ছেলেরা’। একারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে একটি জরিপ চালানো হয়। মেয়েদের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল- তারা পাত্র হিসাবে কি ধরনের ছেলেদের পছন্দ করে। বেশীর ভাগ মেয়ে উত্তর দিয়েছিলÑ কবিতা ভালোবাসে এমন পাত্র তাদের পছন্দ, কিন্তু কবি হলে চলবে না। একদিনের আড্ডায় বিষয়টি এসে পড়লে শহীদ ভাই বলেছিলেন- বুঝলে হাসান, ডাবের পানিটা খাবে কিন্তু ছোবড়াটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
কবি আবুল হাসানের নিয়মিত আড্ডার জায়গা ছিল তখনকার পাবলিক লাইব্রেরীর উত্তর পাশের কোনায় শরীফ মিয়াঁর ক্যান্টিনে। এখানে নিয়মিত আরো আসতেনÑ আহমেদ ছফা, সালাউদ্দিন জাকী, নির্মলেন্দু গুন, মহাদেব সাহা, হাবিবুল্লাহ সিরাজী, রফিক আজাদ, রফিক কায়সার, মোহাম্মদ নুরুল হুদা, হেলাল হাফিজ, সেলিম আল দ্বীন, সানাউল হক খান, অসীম সাহা, মাকিত হায়দার, দাউদ হায়দার, সিহাব সরকারসহ আরো অনেকে। নিজের কোন সৃজনশীলতা না থাকা স্বত্তেও শুধুমাত্র আবুল হাসানের ভাই হওয়ার কারণে এদের সবার সঙ্গে পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ লাভ করেছিলাম।
১৯৭৪ সালের বসন্তে নদী পথে একবার বরিশাল হয়ে গ্রামের বাড়ী যাই। আমার ছোট ভাইবোনদের নিয়ে মা তখন সেখানে। দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে প্রথম আর শেষ বারের মত আবুল হাসান তখন বাড়ীতে গিয়ে হাজির। তখন তো সে বাড়ীতে উৎসবের ধুম লেগে গেছে। তার ছোট ভাইবোনেরা এতদিন পরে দাদাকে নিয়ে আশে পাশের আত্মীয় বাড়ীতে বেড়াচ্ছে। একদিন আমাদের পাশের গ্রামের তাদের ফাতেমা ফুপুর, মানে আমাদের ফতু খালার বাড়ী থেকে বেড়িয়ে আমাদের বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে সবাই খুশী মনে ফিরছিল। ‘ঐ যে টুকু ভাইজান যায়’ চিৎকার করে ছুটে গিয়ে তাকে জাপটে ধরে বড় রাস্তা থেকে আমাদের বাড়ীতে নিয়ে এসেছিলাম।
কয়েকদিন পরে আমরা ঢাকায় ফিরে যাই। তিনি একদিন আমাকে বললেন, তুমি লেখ না কেন? আমি বলি আমি তো কবিতা লিখতে পারি না। তিনি বলেলেন গল্প লেখ। আমি আবার বলি কি বিষয় নিয়ে লিখবো মাথায় আসে না। তিনি এবার বললেন- কেন ঐ যে তুমি রাস্তা থেকে জাপটে ধরে আমাকে বাড়ী নিয়ে গেলে- এটা নিয়েই লেখ না। সেই গল্প লেখা আমার কোনদিন হয়ে ওঠেনি।
টুকু ভাইজেনের সঙ্গে আমার শরীফ মিয়াঁর ক্যান্টিন বা শহরের অন্য কোথাও মাঝে মধ্যে দেখা হয়। কিন্তু আমি জানিনা তিনি কোথায় থাকেন বা তার বাসা কোথায়। এক রাতে তার সাথে গিয়ে আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিমে পল্টন লাইনের এক বাসায় রাত কাটাই। গুনদা ছাড়াও আর একজন- নামটি এখন আমার মনে নেই- সে রাতে ঐ বাসায় ছিলেন। আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। রাতে কেউ ঘুমান না। কেউ পড়েন বোদলেয়ার, কেউ লোরকা বা বুদ্ধদেব বসু। এরা সারারাত জেগে থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুমান। আমি সকালে হলে ফিয়ে এসে মনে মনে ঠিক করলামÑ কবিদের সাথে আর থাকা যাবে না। পরে খোজাখুজির পর জানতে পারি, আবুল হাসান রাত কাটান ঢাকা কলেজের হোস্টেলেÑ তার অনুজপ্রতিম হাসান হাফিজের কক্ষে। কিছুদিন ছিলেন চলচিত্র পরিচালক শাহজাহান চৌধুরীর বাসায় পেইং গেষ্ট হিসাবে।
অনেক আগেই গণবাংলা বন্ধ হয়ে গেছে। কবি আবুল হাসানের চরম আর্থিক সংকট। ঢাকা শহরের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় কবিতা ছাপিয়ে তো চলা যায় না। এদিকে চুয়াত্তরে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতেতে তিনি দৈনিক গণকন্ঠের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ নেন। গণকন্ঠ তখন সরকারের রোষানলে।
কাজে যোগদানের কয়েকমাস পরেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে আবুল হাসান হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। এই হাসপাতালে কয়েক রাত আমি তার সাথে কাটিয়েছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডাক্তাররা বললেন, হৃদপিন্রডের বাল্ব নষ্ট হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এর কোন চিকিৎসা নেই। এমনি পরিস্থিতিতে মহৎপ্রাণ শওকত ওসমান ও শিশু সাহিত্যিক এখলাস উদ্দিন আহমেদ উদ্যোগ নিলেন, সরকারি খরচে আবুল হাসানকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাবার। তখন জট বেধে গেল তার গণকন্ঠে চাকরী করা নিয়ে। সে জটও খুলে যায় শওকত ওসমানের ঐকান্তিক চেষ্টায়। তাকে পাঠানো হল তখনকার সমাজতান্ত্রিক জিডিআর এর রাজধানী পূর্ব বার্লিনে।
কয়েকমাস নিবিড় চিকিৎসা সেবার পর আবুল হাসান পঁচাত্তরের মাঝামাঝি দেশে ফিরে আসেন। আমরা তো তার চেহারার সুন্দর পরিবর্তন দেখে অবাক। কিন্তু পরে জেনেছিলাম বার্লিনের ডাক্তাররা বাংলাদেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিলেন- তার হৃদপিÐের অবস্থা ভালো নয়। যে কোন সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
দেশে ফিরে কিছুদিনের মধ্যে কবি আবুল হাসান প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন বয়সে বড় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাইপস ডিগ্রিধারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অসাধারণ সুন্দরী সুরাইয়া খানমের সঙ্গে। ঢাকা শহরের কবি সাহিত্যিকরা সবাই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। আবুল হাসান ঐ বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত
তৃতীয় কাব্য গ্রন্থ ‘পৃথক পালঙ্ক’ উৎসর্গ করেন সুরাইয়া খানমকে। এই সময় কবি আবুল হাসান একটি বাসা নিয়েছিলেন, মালিবাগ মোড় ছাড়িয়ে আবুজর গিফারী কলেজের দিকে যেতে রাস্তার ডান পাশে। অতি সাধারণ আসবাবহীন একরুমের বাসা। আমি ঐ বাসায় দু’একবার গিয়েছি। আবুল হাসানের দৈহিক ভাষায় আমি বুঝে গিয়েছিলাম, সে বাসার নিয়মিত অতিথি ছিলেন সুরাইয়া খানম।
বার্লিন থেকে ফেরার কয়েক মাসের মধ্যেই কবি আবুল হাসান গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে তাকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথম কয়েক রাত তার কেবিনে আমি ছিলাম। কয়েকদিন পরে গ্রাম থেকে খালাম্মা মেয়ে হোসনে আরা বুড়িকে নিয়ে চলে আসেন। এই সময়েই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু হাফিজুর রহমানের সঙ্গে বুড়ির পরিচয়, যা পরে বিয়েতে গড়ায়। বুড়ি ও হাফিজ দুজনে বর্তমানে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে নাতি নাতনি লালন পালন করছে।
যাহোক, তখন বাংলাদেশের বড় দুঃসময়। আগেই আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটে গেছে। নভেম্বরের তিন ও সাত তারিখে ক্যু এবং পাল্টা ক্যু। চারিদিকে থমথমে অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখেপড়া নেই। আমার টাকা পয়সার টানাটানিও ছিল। আবুল হাসান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতেই আমি খুলনায় চলে যাই। সেখান থেকে তার শারীরিক অবস্থার তাৎক্ষণিক খবর নিতে পারি না। এমনি অবস্থায় ২৭ নভেম্বর দৈনিক খবরের কাগজে তার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই। আর এভাবেই অকালে চলে গেলেন আমাদের বর্ধিত পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী সন্তান আর বাংলা ভাষার একজন প্রতিভাবান কবি।
শেষ করবো, একান্ত নিজের একটি কষ্টের কথা বলে। আমি কবি আবুল হাসানের স্নেহ ও সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম তার আপন ভাইবোনদের চেয়েও বেশী। ঢাকার অনেকেই মনে করতেন তিনি ছিলেন আমার নিজের বড় ভাই। পিজি হাসপাতালের রোগ শয্যায় তাকে দেখতে কত মানুষের ভীড় ছিল। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, সংস্কৃতিসেবী। আগেই উল্লেখ করেছি, কোন্ পরিস্থিতিতে আমি ঢাকা ছেড়ে যাই। মৃত্যুর মাত্র একদিন আগে টুকু ভাইজান খালাম্মাকে বলেছিলেনÑ আচ্ছা মা, রোজ এত মানুষ দেখিÑ শাহনওয়াজ কে দেখি না কেন। কবি আবুল হাসান যখন মারা যান, তার বয়স ছিল ২৮ বছর। আমি ছিলাম ২৫ বছরের। তার
মৃত্যর পরে আমি অনেকদিন খালাম্মার সামনে দাড়াতে পারিনি। গত ৪৩ বছর ধরে আমি বুকের মধ্যে আবুল হাসানের মৃত্যু শয্যার পাশে না থাকার কষ্ট বহন করে চলেছি । আমার মনে হচ্ছে আজ এই সন্ধ্যার আয়োজনে আবুল হাসান সম্পর্কে স্মৃতিচারণে অংশ নিতে পেরে সেই কষ্টের বোঝা থেকে কিছুটা হলেও নিষ্কৃতি পেলাম।
লেখকঃ উপদেষ্টা, সম্পর্ক ম্যাগাজিন
টরন্টো, কানাডা