তুষার গায়েন
জীবনানন্দ দাশের সেই বিখ্যাত কবিতার পঙক্তির মতো একজন নক্ষত্রকে আমরা পৃথিবীর ধুলোপথ ছেড়ে ছায়াপথে বিলীন হয়ে যেতে দেখলাম। অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণের আজ একদিন হ’ল। যখন তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেলাম ফেসবুক নাম্নী নদীর কিনারে, স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ, সাথে সাথেই শোক স্ট্যাটাস দিতে ইচ্ছা হ’ল না। মনে হল তাঁর অনুপস্থিতির শূন্যতাকে অনুভব করাই বরং শ্রেয়, যিনি জীবন ও শিল্পের প্রগাঢ় বন্ধনে আমাদের আপন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন এতগুলো দশক জুড়ে।
‘অপুর সংসার’-এ ঘটনাচক্রে বিয়ে করা ফেলা সেই অপ্রস্তুত তরুণ যে চিলেকোঠায় তার নবপরিণীতা কিশোরী বধুর সামনে নিজের দারিদ্র্য নিয়ে কুণ্ঠিত ও সেই দারিদ্র্যকে অতিক্ৰম করে দাম্পত্যপ্রেমের ঐশ্বর্যে উজ্জ্বল মুখাবয়ব, স্ত্রীর অকালমৃত্যুতে শূন্যতায় ডুবে সংসারবৈরাগ্য এবং পুনরায় শিশু সন্তানের ভিতর ফিরে পাওয়া জীবনের অর্থবোধকতা — এসবই তাঁর অভিনয়ে এত জীবন্ত যে আমরাই অপু হয়ে আয়নায় দেখছি আমাদের মুখ। ‘চারুলতা’-য় আকাশ কালো হয়ে আসা ঝড়ের পূর্বাভাসে, চঞ্চল গতিতে ‘হা রে মধুকৈটভ ভারে’ আওড়াতে আওড়াতে দাদা-বৌদির বাসায় দেবররূপী সৌমিত্রের প্রবেশ, সমস্ত ছবি জুড়ে আলোছায়াময় সূক্ষ্ণ অভিনয়ের মনস্তাত্ত্বিক কারুকাজ আমাদের অভিভূত করে রেখেছে এবং রাখবে ভবিষ্যতেও। চলচ্চিত্র মায়েস্ত্রো সত্যজিৎ রায়ের অধিকাংশ ছবিতে সৌমিত্রই নায়ক — একজন বহুমাত্রিক প্রতিভাধর চলচ্চিত্রকারের সৃষ্টিশীলতাকে ধারণ ও প্রকাশে, দর্শনধারী ও গুণবিচারী, উভয় মানদণ্ডে তাঁর মতো পারদর্শী আর কে ছিল? তরুণ ও মধ্যবয়সে তো বটেই, প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়েও তিনি উপহার দিয়েছেন অসংখ্য চলচ্চিত্র।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, অধিকাংশ অভিনেতা যখন বার্ধক্যে পৌঁছে সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রের গৌণ ভূমিকায় অভিনয় করে টিকে থাকেন, সেখানে সৌমিত্র যে ভূমিকাতেই অভিনয় করুন না কেন ; তাঁর ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতা, কণ্ঠস্বরের মাধুর্য এবং অভিনয় প্রতিভার কারণে সবাইকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠেন ছবির প্রধান আকর্ষণ। তাঁর পাশে বর্তমান কলকাতার তরুণ ও মধ্যবয়সী অভিনেতাদের বামন বলে মনে হয়। আর বার্ধক্যে পৌঁছেও যে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করা যায়, ছবির দর্শকদের চুম্বকের মতো ধরে রাখা যায়, আর্দ্র করে দেয়া যায় চোখের পাতা–তার বড় প্রমান ‘বেলাশেষে’-র অনবদ্য অভিনয়। ভাবা যায়, যে মনোযোগ দিয়ে তরুণ সৌমিত্রের অভিনয় দেখেছি, সেই রকম মনোযোগ তিনি আমাদের কেড়ে নেন এমন এক ব্যতিক্রমী ছবির অপ্রচলিত চরিত্রের অভিনয় দিয়ে !
এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ তিনি শুধু চলচ্চিত্রের অভিনেতাই নন, সমান্তরালে তিনি একজন কবি, আবৃত্তিশিল্পী, চিত্রকর ও লেখক ; সর্বোপরি একজন দূর্দান্ত পাঠক। ফলে তাঁর বোধ ও অনুভবের জগতে বিচিত্র আলো পড়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে মনোজগত। তাই কোনো বিশেষ ধরণের চরিত্রে অভিনয় করে সফল হয়ে যাবার পর, ঐ রকম চরিত্রে পুনরাবৃত্তিমূলক অভিনয়ে আটকে না থেকে, বিচিত্র চরিত্রে অভিনয় করে উত্তীর্ণ হয়েছেন যা খ্যাতিমান শিল্পীদের ভিতর খুব কম দেখা যায়। অভিনেতা সৌমিত্রকে নিয়ে লিখতে গেলে কথার তো শেষ নেই !
তাঁর প্রয়াণে নিজের শোক ও শ্রদ্ধা প্রকাশের একটা ভাষা খুঁজছিলাম, এই লেখা সেই আকুতির একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। আমি তাঁর লোকান্তরিত জীবনে শান্তি ও সৃষ্টিশীলতা কামনা করি ! হে মহানায়ক, আপনাকে আমার নতমস্তক প্রণাম !