এক আলো আঁধারিময় আখ্যান
শাহানা আকতার মহুয়া
তাঁর চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, ‘মিতবাক, স্নেহপরায়ণ, উদাসীন, পরিহাসপ্রিয়, গম্ভীর, আধ্যাত্মিক, খামখেয়ালি, প্রশ্রয় দিতে ওস্তাদ, উৎফুল্ল, কঠিন, কোমল, নৈর্ব্যক্তিক, সুদূর, বিবেকী এবং আবহাওয়ার মতোই পরিবর্তনশীল’ এক মানুষ।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে যে ক’জন বিশেষ নারীর আগমন ঘটেছিল, ওকাম্পো তাদের একজন। রবীন্দ্রনাথ ওকাম্পোর প্রতি বিশেষ মুগ্ধ ছিলেন। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার চিন্তা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রভাবিতও ছিলেন। ১৯১৪ সালে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়েন। অন্য পাঠকদের মতোই রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিরাজ্যে প্রবেশ করে ওকাম্পো আবিষ্ট হয়ে পড়েন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে।
১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ পেরু ও মেক্সিকো ভ্রমণ করছিলেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে অবস্থান করতে হয়। কবির এ অবস্থানের খবর শুনে ছুটে আসেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। তিনি রবীন্দ্রনাথকে তার বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানান। রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো প্রথম দর্শনেই রবীন্দ্রনাথকে দেখে শিহরিত হয়েছিলেন। তার স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথকে প্রথম দর্শনের বিষয়ে লিখেছেন, ‘প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এ-ও সত্যি যে, ঘরে যেন তিনি নেই। তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী। অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোনো দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তার সোনালি শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তার সমগ্র মুখাবয়বের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তার কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব।’
এসেছিলেন কেবল এক ঝলক দেখবার জন্য; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ জেনে অনেকটা জোর করেই তাঁকে হোটেল থেকে তুলে নেন ওকাম্পো, থাকার বন্দোবস্ত করলেন তাঁর এক আত্মীয়ের ভাড়া বাসায়। বাড়িটির নাম ‘মিরালরিও’। সত্তরের দশকে জ্যোতির্ময় মৌলিক এ বাড়িটিকে নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকায়Ñ ‘বিজয়ার করকমলে’। লেখাটিতে জ্যোতির্ময় মৌলিক ‘মিরালরিও’ শব্দটির অর্থ করেছিলেন ‘গ্রোতস্বিনীকে দেখা’Ñ
‘একটি উঁচু মালভ‚মির উপর বাসাটি অবস্থিত। এর সামনে আর পেছনে বিশাল প্রাঙ্গণ। সবুজ ঘাসের গালিচা মোড়া এ প্রাঙ্গণটির সৌন্দর্য ছিল অবর্ণনীয়। বাড়ি থেকে উত্তর দিকে কয়েক পা অগ্রসর হলেই দেখতে পাওয়া যায় তটরেখা-বিহীন বিশাল নদী ‘প্লাতা’। প্লাতা শব্দটির অর্থ রূপা’। ওকাম্পোর সঙ্গে তাঁর জন্য নির্ধারিত বাসাটিতে যেদিন পৌঁছান, সে দিনটি ছিল এমনিতেই একটু অন্যরকম। ওকাম্পোর ভাষায়Ñ
‘সেই বিকেলে আকাশ ক্রমেই হলুদ হয়ে আসছিল, আর বিশাল ঘন কালো মেঘ। এমন ভয়ঙ্কর গুরু মেঘ, অথচ এমন তীব্র ভাস্বরÑ কখনো এমন দেখিনি। আকাশ কোথাও সীসার মতন ধূসর, কোথাও মুক্তার মতো, কোথাও বা গন্ধকের মতো হলুদ, আর এতেই আরো তীব্র হয়ে উঠেছে নদীতট, আর তরুশ্রেণীর সবুজ আভা। ঊর্ধ্ব আকাশে যা ঘটেছিল, জলের মধ্যে তাই ফলিয়ে তুলেছিল নদী। কবির ঘরের বারান্দা থেকে দেখছিলাম এই আকাশ, নদী, বসন্তের সাজে ভরা প্রান্তর। বালুচরের উইলো গাছগুলি খেলা করছিল ছোট ছোট হাজারো নম্র পাতায়।
ঘরে ঢুকতেই ওঁকে নিয়ে এলাম অলিন্দে, বললাম- নদীটি দেখতেই হবে। সমস্ত প্রকৃতি যেন আমার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে দৃশ্যটাকে করে তুলল পরম রমণীয়। আলোর পাড়ে বোনা প্রবল মেঘপুঞ্জের অন্তরালে কে যেন প্রতিফলক সাজিয়ে ধরেছে আকাশে।’
ওকাম্পো, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো, ভিক্টোরিয়া শব্দটিকে বাংলায়ন করে রবীন্দ্রনাথ যার নাম দিয়েছিলেন ‘বিজয়া’। নারীবাদী লেখক, সামাজিক কর্মী ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথের আত্মিক একটা সম্পর্ক যেন মোনালিসার হাসির মতোই রহস্যময় একটা সম্পর্ক।
দেখতে শুনতে সুদর্শন এবং সেই সাথে অসম্ভব প্রতিভাধর রবীন্দ্রনাথ যৌবনে তো বহু নারীর হৃদয় হরণ করেছিলেনই, এমনকি শেষ বয়সেও তাঁর খ্যাতি, যশ এবং প্রতিভার জৌলুসে অনেক তরুণের চেয়ে ঢের বেশি পূর্ণযৌবনা নারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারতেন, জাগাতে পারতেন অহর্নিশি তাঁদের হৃদয়ে দোলা
‘লা নুই বেঙ্গলি’ যেমন দেখেছি ষোল সতের বছরের মৈত্রেয়ী দেবী প্রায় সত্তর বছরের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন, খাতা জুড়ে পাতার পর পাতা রবীন্দ্রনাথের নাম লিখতেন। মৈত্রেয়ীর প্রেমিক মির্চা এলিয়াদকে ব্যাপারটা এতোটাই পরশ্রীকাতর এবং উদভ্রান্ত করে তুলেছিল যে, উপন্যাসের নায়ক অ্যালেনের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘ [Tagore, that] … disgusting old charlatan! Corrupter of young girls’। এমনকি একটা সময় মৈত্রেয়ী কাউকে বিয়ে করবে না বলে ঠিক করেছিল। এমন একটা ফ্যান্টাসির জগত আরেক কিশোরী রাণু অধিকারীর মধ্যেও আমরা দেখতে পাই। কৈশোরে রাণু ভেবেছিলো ‘পাখি আমার নীড়ের পাখি’ বুঝি তাঁকে নিয়েই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; একটা সময় রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার জ্যোতিতে বিভ্রান্ত হয়ে তাঁকে ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’ বানিয়ে বিয়ে থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন রাণু। এহেন প্রতিভার ধাক্কা কেবল মৈত্রেয়ী বা রাণু নয়, ওকাম্পোর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল, নির্দ্বিধায় বলা যায়। ওকাম্পোর বয়স তখন চৌত্রিশ আর কবিগুরুর বয়স তেষট্টি।
গীতাঞ্জলি পড়েই ওকাম্পো যে প্রাথমিকভাবে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তা আমরা জানি। কিন্তু বিপরীতটিও কি সত্য নয়? সেই শৈশব থেকে শুরু করে মৃত্যু অবধি কম নারী রবীন্দ্রনাথের জীবনে আসেনি। কিন্তু জ্ঞানে, গুণে, ব্যক্তিত্বে, সৌন্দর্যে এবং কর্মস্পৃহায় বোধ করি ওকাম্পো ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রম। একে তো সৌন্দর্যে তিনি ছিলেন অতুলনীয়, অর্তেগা তাঁকে ডাকতেন ‘ La Gioconda del sur’ বা ‘দক্ষিণের মোনালিসা’ বলে; আর মননে এবং প্রজ্ঞাতেও ছিলেন সে অঞ্চলের নারীদের থেকে অগ্রগামী।
প্রতিমা দেবীর (শঙ্খ ঘোষ, ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’) বক্তব্য অনুযায়ী জানা যায়, ভিকতোরিয়ার ইংরেজি খুব ভাঙা ভাঙা, কিন্তু ১৯৬২সালে মায়ারের সঙ্গে যখন ওকাম্পোর দেখা হয়, তখন তিনি বৃটিশ অ্যাকসেন্টে ত্রæটিহীন ইংরেজি বলেন। ওকাম্পোকে যখন সবাই ডাকসাইটে সুন্দরী বলে জানতেন, প্রতিমা দেবী হয়ত তাঁর স্বদেশী মাপকাঠিতে লেখেন, ‘সুন্দরী বলা চলে না, যদিও বুদ্ধির প্রখরতা তাঁর মুখে একটি সৌন্দর্যের দীপ্তি এনে দিত এবং তাঁর বড়ো বড়ো গাঢ় পল্লবে ঢাকা গাঢ় নীল চোখে একটি স্বপ্নময়ী আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল।’
সাহিত্যিক ওয়ালদো ফ্রাঙ্ক বলেন, ‘ভিক্টোরিয়ার জীবনে রূপ, বিত্ত এবং ধীশক্তিÑ তিনটিই যেন ছিল অভিশাপতুল্য। কিন্তু তিনটি অভিশাপকেই তিনি অতিক্রম করতে পেরেছেন। …ভিক্টোরিয়া কোন পরিস্থিতিতেই বাইরে থেকে সহজবোধ্য নন। তাঁরা নিটোল, সুন্দর দীর্ঘদেহ আড়াল করে রাখে তাঁর স্বভাবের সংবেদনশীলতা আর লাজুকতা। তাঁর নারীসুলভ বেদিত্ব ঢেকে রাখে তাঁর সাহসকে, যা প্রায়শই দুঃসাহস। তাঁর নাগরিক বৈদগ্ধের নীচে ঢাকা থাকে আসল মানুষটাÑ যিনি সহজিয়া হৃদয়াবেগে কৃষাণীর মতো, দাক্ষিণ্য আর প্রতিক্রিয়ার তীব্রতায় শিশুর মতো। আর তাঁর আর্থিক ক্ষমতাকে নিবেদিত করেছেন তাঁর মূল্যবোধের সেবায়; শিল্পীর মূল্যের ও স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠায়’।
১৯২০ সাল থেকেই ‘লা নেসিয়ন’-এর মতো পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছিলেন ওকাম্পো আর তাঁর বন্ধুচক্রের পরিধি ছিল অবিশ্বাস্য। তাঁর ‘সুর’ পত্রিকায় অনার্জেন্টাইন যাঁদের লেখা বেরিয়েছ তাঁদের মধ্যে টমাস মান, টি এস এলিয়ট, হেনরি মিলার, জাক মারিত্যাঁ, পল ক্লোদেল, এজরা পাউন্ড, অকতাভিও পাস্ ৃ কে নেই! তিনি নিজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদও করেছেন। লিখেছেন ২৫টির মতো বই। তাঁর অনূদিত লেখকের তালিকায় আছেন কামু, টি ই লরেন্স, ফকনার, ডিলান টমাস, গ্রাহাম গ্রিন, জন অসবোর্ন সহ অনেকেই। ১৯৩১ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী ৪০ বছর ‘সুর’ ( Sur) পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি, যে পত্রিকাটিতে ক্রমাগতভাবে লিখেছেন হর্হে লুইস বর্হেস, মার্সেল প্রুস্ত, টমাস মান, টি এস এলিয়ট, হেনরি মিলার, জ্যাক মারিত্যাঁ, পল ক্লোদেল, অল্ডাস হাক্সলি, সিমোন ওয়াইল, লিউইস মামফোর্ড, আঁদ্রে জিদ, মার্টিন হাইডেগার, এজরা পাউন্ড, ইভলিন ওয়, লরেন্স ডারেল, জাঁ পিয়াজে, আঁদ্রে ব্রেত, অক্টাভিয়ো পাজের মতো লেখক লেখিকারা। তিনি ছিলেন স্পষ্টবক্তা। নারী স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি কাউকে ছাড় দেননি। তাঁর কাছের মার্কসবাদী বন্ধুবান্ধবদের অনেকে তখন ভাবতেন নারীস্বাধীনতা আর নারীমুক্তি নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করার কিছু নেই। অর্থনৈতিক সাম্য এবং কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা হলে নারীমুক্তি এমনিতেই ঘটে যাবে। ওকাম্পো তা মেনে নেননি। তিনি এর প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘না …আগে দুনিয়ার মেয়েদের অবস্থা পাল্টাতে হবে, তারপর তা থেকেই অন্য পরিবর্তনগুলো আসবে; উল্টোটা নয়’।
রবীন্দ্রনাথকে আমরা যে চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ হিসেবে পাই, তার পেছনেও ওকাম্পোর বিশেষ অবদান রয়েছে। অন্যদিকে রবীন্দ্র-জীবনের আরেকটি জায়গায় ওকাম্পোর অবদানের খোঁজ পাওয়া যায়- খুব প্রচ্ছন্নভাবে হলেও। সেটি হল রবীন্দ্রনাথের নারী ভাবনার ক্রমিক উন্নয়নে। ওকাম্পোর সাথে রবীন্দ্রনাথের যে সময়টাতে দেখা হয়েছিল, তার আগেকার কিংবা সমসাময়িক প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী, ডায়েরি কিংবা চিঠিপত্র পাঠ করলে অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয় নারী সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা হলেও সনাতন, ঐতিহ্যপন্থি এবং ক্ষেত্রবিশেষে উদগ্রভাবেই পুরুষতান্ত্রিক ছিল। নারী সম্পর্কে রবীন্দ্র ভাবনার চালচিত্র খুব সার্থকভাবে ধরা পড়ে তাঁর ‘রমাবাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে’ (১৮৮৯) নামক প্রবন্ধে। প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ নারী স্বাধীনতা এবং নারী অধিকারকে ‘কোলাহল’ হিসেবে উল্লেখ করে লেখেন:
‘আজকাল পুরুষাশ্রয়ের বিরুদ্ধে যে একটা কোলাহল উঠেছে, সেটা আমার অসংগত এবং অমঙ্গলজনক মনে হয়। পূর্বকালে মেয়েরা পুরুষের অধীনতাগ্রহণকে একটা ধর্ম মনে করত; তাতে এই হত যে, চরিত্রের উপরে অধীনতার কুফল ফলতে পারত না, অর্থাৎ হীনতা জন্মাত না, এমন-কি, অধীনতাতেই চরিত্রের মহত্ত¡সম্পাদন করত। প্রভুভক্তিকে যদি ধর্ম মনে করে তা হলে ভৃত্যের মনে মনুষ্যত্বের হানি হয় না। রাজভক্তি সম্বন্ধেও তাই বলা যায়’।
নারী অধিকার চাওয়ার প্রচেষ্টাকে ‘নাকী সুরে ক্রন্দনের’ সাথে তুলনা করে রবীন্দ্রনাথ এও বলেছিলেন:
‘আজকাল একদল মেয়ে ক্রমাগত নাকী সুরে বলছে, আমরা পুরুষের অধীন, আমরা পুরুষের আশ্রয়ে আছি, আমাদের অবস্থা অতি শোচনীয়। তাতে করে কেবল এই হচ্ছে যে, স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধবন্ধন হীনতা প্রাপ্ত হচ্ছে; অথচ সে-বন্ধন ছেদন করবার কোনো উপায় নেই’।
কেতকী কুশারী ডাইসন অনুমান করেছেন,‘কবির প্রৌঢ় বয়সের সৃজনকর্মে প্রেরণা জোগানো ছাড়াও নারীবিষয়ক চিন্তনের ক্ষেত্রে তাঁর বিবর্তনকে সূক্ষভাবে খানিকটা প্রভাবিত করেছিলেন ভিক্তোরিয়া’। যে কবিগুরু একটা সময় নারীদের মধ্যে কেবল জায়া আর জননী খুঁজতেন, ‘প্রকৃতির’ দোহাই দিয়ে মেয়েদের গৃহবন্দি রাখার উপদেশ দিতেন, সে কবিই ওকাম্পোর সাথে দেখা হবার চার বছরের মাথায় আঁকলেন এক সবলা নারীর প্রতিচ্ছবি-
‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার
কেন নাহি দিবে অধিকার
হে বিধাতা?’
এছাড়াও ‘আমরা দুজনা স্বর্গ খেলনা, গড়িব না ধরনীতে’ কিংবা ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থি’সহ বেশ কিছু গান কবিতার উল্লেখ করা যেতে পারে যেখানে নারীপুরুষের চিরন্তন ছকের বাইরে গিয়ে তাদের সম্পর্ককে দেখতে পেরেছিলেন রবিঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের শেষ দিককার অমর প্রেমের উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’য় আগমন ঘটে জ্ঞানী, গুণী, বিদুষী এবং প্রথাভাঙা এক বলিষ্ঠ নারীর। লাবণ্য। অমিতের জীবনে ‘ঘড়ার জল’ হবার চাইতে ‘দীঘি’ হিসেবে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো তাঁর। আমরা জানি রবিঠাকুরের শত আমন্ত্রণ সত্তে¡ও ভারতবর্ষে আসেননি ওকাম্পো। আসেননি শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর সাথে দিনযাপন করতে। হয়তো, রবি ঠাকুরের জীবনে ‘ঘড়ার জল’ হয়ে থাকার চাইতে প্লাতা নদীর মতোই বহমান থাকতে চেয়েছেন তিনি। লাবণ্য-অমিতের বিদায় বেলায় যে বিখ্যাত লাইনগুলো শেষের কবিতায় সন্নিবেশিত হয়েছে- ‘হে ঐশ্বর্যবান/ তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান/ গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়’-এর সাথে মিল পাওয়া যায় ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠির। ওকাম্পো সে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন,‘ All I received from you has made me so rich in love that the more I spend, the more I have to give. And all I give comes from yourself…. So I feel I am giving nothing. ’।
১৯২৮ সালে বাঙ্গালোরে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের বাংলোয় বসে ‘শেষের কবিতা’ সমাপ্তির প্রাক্কালে এক প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, লাবণ্য তাঁর খুব চেনা চরিত্রÑ ‘লাবণ্যর সঙ্গে যেন আমার চেনাশোনা আছে, খুব যেন কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি।’
রবীন্দ্র-জীবনে ওকাম্পোর আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ বয়সে ‘চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ছবি আঁকার শখকে উল্লেখ করেছেন ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’ বলে। ওকাম্পো লিখেছেনÑ
‘ওঁর একটি ছোঁ খাতা টেবিলে পড়ে থাকতো, ওরই মধ্যে কবিতা লিখতেন বাংলায়। বাংলা বলেই যখন-তখন খাতাটা খুলে দেখা আমার পক্ষে তেমন দোষের কিছু ছিল না। এই খাতা আমায় বিস্মিত করল, মুগ্ধ করল। লেখার নানা কাটাকুটিকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তার ওপর কলমের আঁচড় কাটতে যেন মজা পেতেন কবি। এই আঁকিবুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতো নানা রকমের মুখ, প্রাগৈতিহাসিক দানব, সরীসৃপ অথবা নানা আবোলতাবোল। সমস্ত ভুল, সমস্ত বাতিল করা লাইন, কবিতা থেকে বহিষ্কৃত সব শব্দ এমনি করে পুনর্জীবিত হতো এক ভিন্ন রূপের জগতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে যেন স্নিগ্ধ কৌতুকে হাসত তারা …এই ছোট খাতাটাই হলো শিল্পী রবীন্দ্রনাথের সূচনাপর্ব।’
ওকাম্পোর বাসায় বসে কবিতা লিখতে গিয়ে কবিগুরু যে সমস্ত বিচিত্র কাটাকুটি করতেন, তা দেখে মাঝে মাঝে ওকাম্পো ঠাট্টা করে বলে বসতেন- ‘সাবধান, তোমার কবিতায় যত ভুলভ্রান্তি থাকবে, তুমি তো তত বেশিই ছবি এঁকে মজা পাবে। শেষে দেখবে যে, নিজে ইচ্ছে করেই বাজে কবিতা লিখছো’।
ওকাম্পো আরো লিখেছেন-
‘…তাঁর এই আঁকিবুঁকিতে তো আমি মেতে গেলাম। ব্যাপারটায় ওঁকে উশকে দিলাম। সান ইসিদ্রোর ছ’বছর পর প্যারিসে যখন আবার দেখা হলো কবির সাথে, ঐ খেলা তখন দাঁড়িয়ে গেছে ছবিতে’।
রবীন্দ্রনাথের মাথায় তাঁর ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর সুপ্ত একটা আকাক্সক্ষা ছিল বটে, আর সেজন্য ১৯৩০ সালে প্যারিসে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর হাতে আঁকা চারশো ছবি; কিন্তু প্যারিসে গিয়ে বুঝলেন, সেখানে ছবির প্রদর্শনী করা অত সহজ নয়। ভাল গ্যালারি এমনিতেই চট করে পাওয়া যায় না, আর তার মধ্যে আবার প্যারিসে রবীন্দ্রনাথের জানাশোনাও ছিল কম।
কিন্তু এবারেও উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন সেই ওকাম্পো। সৌভাগ্যবশতঃ সেই সময়টা ওকাম্পো প্যারিসেই ছিলেন। খবর পেয়েই চলে এলেন তিনি। রবিঠাকুরের সাথে তাঁর ২য় সাক্ষাৎ এটি (১৯৩০ সালের এপ্রিল)। এসেই খুব কম সময়ের মধ্যে পিগাল গ্যালারিতে রবিঠাকুরের ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে ফেললেন তিনি। এমনকি তাঁর বন্ধু লেখিকা কঁতেস দ্য নোয়াইকে দিয়ে চিত্রসূচির একটা ভূমিকাও লিখিয়ে নিলেন ওকাম্পো। এত দ্রুত এবং সুচারুভাবে তিনি কাজগুলো সমাধান করে ফেললেন যা সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল। ওকাম্পো যে কী অসাধারণ দ্রুততায় এবং দক্ষতায় প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন তার সাক্ষ্য সমসাময়িক অনেকের লেখাতেই ছড়িয়ে আছে। যেমন, রথীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’তে উল্লেখ করেছেন-
‘১৯৩০ সালে বাবা আবার যখন প্যারিস যান, সঙ্গে ছিল তাঁর আঁকা কিছু ছবি। ছবি দেখে কয়েকজন ফরাসি শিল্পী বাবাকে একটা চিত্রপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেল, চট করে প্যারিস শহরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা অসম্ভব বললেই হয়। মোটামুটি একটা পছন্দসই হল পেতে হলে বছর খানেক আগে থেকে চেষ্টাচরিত্র করতে হয়। বাবা সেনিওরা ওকাম্পোকে তারযোগে অনুরোধ জানালেন তিনি এসে যেন বাবার সহায় হন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি চলে এলেন এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হল বিনা আয়াসেই প্রদর্শনীর সব রকম ব্যবস্থা তাঁর সাহায্যে হয়ে গেল’।
এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রতিমা দেবীকে ২ মে, ১৯৩০ তারিখে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন, ‘ভিক্টোরিয়া যদি না থাকত, তাহলে ছবি ভালই হোক আর মন্দই হোক, কারো চোখে পড়ত না। একদিন রথী ভেবেছিল ঘর পেলেই ছবির প্রদর্শনী আপনিই ঘটে- অত্যন্ত ভুল। এর এত কাঠখড় আছে যে, সে আমাদের অসাধ্য-আঁন্দ্রের পক্ষেও। খরচ কম হয়নি- তিন-চারশো পাউন্ড হবে। ভিক্টোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্চে। এখানকার সমস্ত বড় বড় গুণীজনদের ও জানে- ডাক দিলেই তারা আসে। কঁতেস দ্য নোয়াইও উৎসাহের সঙ্গে লেগেচে- এমনি করে দেখতে দেখতে চারিদিক সরগরম করে তুলেচে। আজ বিকেলে দ্বারোদঘাঁন হবে- তারপরে কি হয় সেটাই দ্রষ্টব্য’
রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পো পরস্পরের মধ্যে কমপক্ষে অর্ধশত চিঠি চালাচালি করেছেন। প্রথম সাক্ষাতেই যে ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথের মন জয় করে নিয়েছিলেন সেটির প্রমাণ পাওয়া যায় তার লেখা সে সময়ের কবিতাগুলো ঘাঁলে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ওকাম্পোকে চিঠিতে লেখেন, ‘তুমি জানো যে, ভাস্বর সেই দিনগুলি আর তার কোমল শুশ্রূষার স্মৃতিপুঞ্জ ধরা আছে আমার কবিতাগুচ্ছে, হয়তো আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা (পূরবী)। পলাতক স্মৃতিগুলি আজ কথায় বন্দি। …তোমাকে নিশ্চিত বলতে পারি যে, এ কবিতা বেঁচে থাকবে অনেকদিন।’
সমীর সেনগুপ্তের ‘রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা’ গ্রন্থে ওকাম্পোর ডায়েরির বাংলা অনুবাদ সংযুক্ত হয়েছেঃ
‘মাঝে মাঝে যখন আমি দেখতাম তিনি তাঁর রহস্যময় বাংলা হরফে লিখছেন, লিখছেন লিখেই যাচ্ছেন, কখনো কখনো আমি তাঁকে অনুরোধ করতাম কবিতাটির একটি অংশ আমার জন্য তরজমা করে শোনাতে। একদিন বিকেলে আমি ফুলদানিতে ফুল সাজাবার জন্য তাঁর ঘরে ঢুকেছি, তিনি বললেন যে তিনি তর্জমা করছেন। টেবিলে খোলা পৃষ্ঠাটির উপরে আমি ঝুঁকে পড়লাম। আমার দিকে মুখ না তুলে তিনি হাত বাড়ালেন, এবং যেভাবে লোকে গাছের ডালে একটি ফলকে ধরে, সেইভাবে আমার একটি স্তনের উপরে হাত রাখলেন। আমার মনে হল, আমার সমস্ত শরীরের ভেতর দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে গেল, আমি কুঁকড়ে গেলাম- একটা ঘোড়াকে যেন তাঁর মালিক আদর করছে এমন এক সময়ে যখন সে সেটা আশা করছে না। আমার ভিতরের জন্তুটা চিৎকার করে উঠল: ‘না! না!’। কিন্তু আমারই ভেতর আরেকটা মানুষ যেন সাবধান করে দিল জন্তুটাকে: ‘মূর্খ! শান্ত হয়ে দাঁড়াও। বহু দেববাদী ধর্মের স্নেহপ্রকাশের শরীরী ভঙ্গি এটি, জরাগ্রস্তের লালসা নয়।
প্রায় বিদেহীভাবে আমাকে আদর জানিয়ে হাতটি সরে গেল, আমি কবিতাটি পড়লাম। কিন্তু তিনি পরে আর কখনো এরকম করেননি। প্রতিদিন তিনি আমার কপালে অথবা গালে চুম্বন করতেন, আমার হাত ধরে বলতেন, কী স্নিগ্ধ হাত তোমার!’
বাসার অলিন্দ থেকে ওকাম্পোর সাথে মিলে নদী দেখতেন রবীন্দ্রনাথ, দেখতেন নদীর জলে রঙের পরিবর্তনের মায়াবী খেলা। কখনো কখনো রবিঠাকুর বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন ওকাম্পোকে, ওকাম্পো মন্ত্রমুগ্ধের মতোন শুনতেন। ওকাম্পো তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন, সে আবৃত্তিই গান হয়ে উঠতো। শব্দগুলি উনি এমন বিশুদ্ধ স্পষ্টতার সাথে উচ্চারণ করতে পারতেন যে, আমি কিছু কিছু শব্দ স্মৃতিস্থ করে পুনরুচ্চারণ করতে পারতাম’। আর ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী’ – বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতটির কথা তো এখানে অবধারিতভাবেই এসে পড়বে। এই বিখ্যাত গানটির ইংরেজি অনুবাদ ওকাম্পোর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রবিঠাকুর, আর্জেন্টিনা আসার কয়েকদিনের মধ্যেই। মূল গানটি কবি লিখেছিলেন শিলাইদহে বহুদিন আগে- সেই ১৮৯৫ সালে। গানটি রচনা করার ত্রিশ বছর পরে রবি ঠাকুর হয়তো ওকাম্পোর মধ্যেই আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর পরম আরাধ্য সত্যিকার ‘বিদেশিনী’কে। শান্তিনিকেতন থেকে ওকাম্পোকে প্রায়ই লিখতেন-
‘আমার মন চলে যায় সান ইসিদ্রোর বারান্দাটিতে। স্পষ্ট এখনো মনে পড়ে সকালবেলা আলোয় ভরা বিচিত্র লাল নীল ফুলের উৎসব। আর বিরাঁ সেই নদীর উপর নিরন্তর রঙের খেলা, আমার নির্জন অলিন্দ থেকে অক্লান্ত সেই চেয়ে দেখা’।
ওকাম্পোর ওপর রবিঠাকুরের যেমন প্রভাব ছিল, রবিঠাকুরের সৃষ্টির পেছনেও ওকাম্পোর প্রভাব ছিল অসমান্য। তুলনামূলক বিচারে এই প্রভাব ওকাম্পোর উপর প্রভাবের চেয়ে কম ছিল না, বরং হয়তো ছিল খানিকটা বেশিই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা ওকাম্পোকে মাথায় রেখেই লিখেছিলেন বলে অনুমিত হয়। পূরবীর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে। ১৯২৫ সালটিকে আজ ‘বাংলা কবিতার আধুনিকতার সূচনাকাল’ হিসেবে গণ্য করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। আমরা জানি কবি বুদ্ধদেব বসু’র প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মর্মবাণী’ প্রকাশিত হয়েছিল ঐ বছর। শুধু তাই নয় কল্লোল, কালি-কলম, উত্তরা এবং প্রগতির মতো সাহিত্যপত্রের সূচনাও হয়েছিল সমসাময়িক কালেই। পাশ্চাত্যেও এ সময়ই প্রকাশিত হয় টি. এস. এলিয়টের The Waste Land কাব্যগ্রন্থ এবং নোবেল বিজয়ী কবি ইয়েটসের Vision। রুশ কবি সের্গেই ইয়েসেনিন সে বছরই তাঁর রক্তকে কালি বানিয়ে লিখেছিলেন তাঁর বিদায়ী কবিতা ‘গুড বাই মাই ফ্রেন্ড’। রবিঠাকুরও তাঁর এই কবিতার বইটিকে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন ১৯২৫ সালেই এবং কাব্যগ্রন্থটি রবিঠাকুর উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে ‘বিজয়ার করকমলে’। বইটি প্রকাশের পর ওকাম্পোকে পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু। ১৯২৫ সালের ২৯শে অক্টোবর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন,
‘বাংলা কবিতার একটা বই তোমায় পাঠাচ্ছি, যেটা তোমার হাতে নিজে তুলে দিতে পারলেই খুশি হতুম। বইখানা তোমায় উৎসর্গ করা, যদিও এর ভিতরে কী রয়েছে তা তুমি জানতে পারবে না। এই বইয়ের অনেক কবিতাই লেখা হয়েছিল সান ইসিদ্রোয় থাকার সময়ে’।
এর বহুদিন পরে ১৯৪০ সালের জুন মাসে ওকাম্পো চিঠিতে জানতে চেয়েছিলেন : ‘কবি, যে বইটি তুমি আমাকে উৎসর্গ করেছিলে তার নাম কি?’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪০ সালের ১০ই জুলাইয়ের চিঠিতে এর উত্তরে জানিয়েছিলেন, ‘যে বইটি তোমাকে উৎসর্গ করেছিলাম তার নাম জানতে চেয়েছ। এর নাম পূরবী; মানে পূর্বদিক-স্ত্রী লিঙ্গে।’
রোমান্টিক কবি রবীন্দ্রনাথের প্রেমের বর্ণীল স্ফুরণ ছিল এই কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স ততোদিনে ষাট বছর অতিক্রান্ত হলেও কিন্তু তাঁর প্রেমের তৃষ্ণা মরেনি। ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় যেন, চির তারুণ্যের কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবন সায়াহ্নে এসেও প্রেম, সৌন্দর্য আর মাধুর্যের রসে একেবারে টইটম্বুর। এ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘তপোভঙ্গ’, ‘লীলাসঙ্গিনী’, ‘আহ্বান’, কিংবা ‘শেষ বসন্ত’ কবিতাগুলো পড়লে মনে হয় কবির জীবনে হঠাৎই যেন ‘চির বসন্তের’ আগমন ঘটেছিল সে সময়, আর যৌবনের ‘মানস সুন্দরী’ যেন বার্ধক্যে এসে ‘লীলাসঙ্গিনী’তে রূপায়িত।
পূরবী কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে রবীন্দ্রনাথ কোথাও সরাসরি ওকাম্পোর নামোল্লেখ করেননি, কিন্তু ‘বিদেশী ফুল’, ‘অতিথি’, ‘আশঙ্কা’, তপোভঙ্গ’, ‘আহ্বান’, ‘অন্তর্হিতা’, ‘মিলন’, ‘বদল’ কিংবা ‘শেষ বসন্ত’সহ বহু কবিতায় ওকাম্পো যেন প্রবলভাবেই দীপ্যমান। ‘বৈতরণী’ কবিতাটি পড়লে মনে হয় কবি যেন মিরালরিওর বাড়ির অলিন্দে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রেয়সীর সাথে রিও দে লা প্লাতা নদীর সৌন্দর্য উপভোগরত। যতদিন এই প্লাতা নদীর জল বইবে, যতদিন পূরবী কাব্যগ্রন্থ টিকে থাকবে, ততদিন মর্মর সুরে বইবে রবিঠাকুর আর তাঁর প্রেয়সী ওকাম্পোর রোমান্টিক অভিসারের অশ্রুত কলকাকলি। এই ‘প্লাতা নদীর ধারে’ বসে অনেক প্রেমময় কবিতা লিখেছিলেন কবি, কিছু লিখেছিলেন তাঁর বাড়ির অলিন্দে, কিছুবা লিখেছিলেন বাড়ির বাগানে ‘গাছের ছায়ায়’ বসে।
অবশ্য কেবল ‘পূরবী’ নয়, এর পরে প্রকাশিত যোগাযোগ উপন্যাস (১৯২৮) এবং ‘মহুয়া’ (১৯২৯)র অনেক কবিতায় (প্রতীক্ষা, বাপী, প্রচ্ছন্ন, অসমাপ্ত, দূত, আহবান, দীনা ইত্যাদি) ওকাম্পোর ছায়া দেখতে পান রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ কেতকী কুশারী ডাইসনসহ অনেকে। এমনকি মহুয়া কাব্যগ্রন্থের পরেও নানা কবিতায় কেতকী লক্ষ্য করেছেন ওকাম্পোর সরব উপস্থিতি নির্বাক, ভীরু, তুমি (পরিশেষ, ১৯২৩); অচেনা, আরশি, প্রভেদ, নীহারিকা, অনাগতা, বিদায়, বেসুর (বিচিত্রিতা, ১৯৩০), শেষ সপ্তকের (১৯৩৫) সকল কবিতা, উদাসীন, বিহ্বলতা, ব্যর্থ মিলন, অপরাধিনী, বিচ্ছেদ, বিদ্রোহী, ক্ষণিক, রাতের দান, অন্তরাত্মা (বীথিকা, ১৯৩৫), মায়া, নারী, হঠাৎ মিলন, দূরবর্তিনী, বিমুখতা, অসময়, মানসী, শেষ কথা (সানাই, ১৯৪০) ইত্যাদি। অবশ্য সে কবিতাগুলোর সবগুলোই কেবল ‘ব্যক্তিপ্রেম’ নির্ভর নাকি একান্তই ‘নৈর্ব্যক্তিক’, এ প্রশ্ন তোলাই যায়, যেমনটি তুলেছেন সাহিত্য সমালোচক নিত্যপ্রিয় ঘোষ, তাঁর ‘সন্ধানের সাহস’ প্রবন্ধে; বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী প্রেমের কবিতাগুলো একমাত্র ওকাম্পো-অনুপ্রাণিত, সেই সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়Ñ রবীন্দ্রনাথের পৃথিবীকে তাহলে অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ করে ফেলা হয়।
ওকাম্পোর থেকে বিদায় নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালের ১১ই মে। প্যারিসের র্গা দ্যু র্ন রেলস্টেশনে ধারণ করা আছে তাঁদের সেই শেষ বিদায়ের দৃশ্য। প্যাট্রিশিয়া স্টেইনারের ভাষ্য অনুযায়ী, রেলস্টেশনে তোলা বিখ্যাত সেই ছবিতে তাঁদের দেখাচ্ছিল ম্লান এবং বেদনার্ত।
কেতকী কুশারী ডাইসন তাঁর ‘ইন ইয়োর ব্লসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন’ বইয়ে নানা চিঠিপত্র দলিল উদ্ধার করে দেখিয়েছেন, কবিগুরু আসলে চেয়েছিলেন ওকাম্পো তাঁর সঙ্গে ইংল্যান্ড যান, হিবার্ঁ বক্তৃতা শোনেন আর তারপর রবীন্দ্রনাথের সাথে ফিরেন ভারতবর্ষে। কিন্তু ওকাম্পোর মাথায় ছিল তাঁর সম্ভাব্য ‘সুর’ পত্রিকা নিয়ে নানা পরিকল্পনা, তাই ইচ্ছা সত্তে¡ও তিনি রবিঠাকুরের সাথে ভ্রমণে যেতে পারেননি। ইনফ্যাক্ট, আমরা আজ জানি, ওকাম্পো তাঁর সারা জীবনে কখনোই ভারতে গিয়ে উঠতে পারেননি। রবিঠাকুর অবশ্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আশা করে গিয়েছিলেন ওকাম্পো কোন না কোন দিন ভারতে আসবেন, ভারতবর্ষে এসে রবিঠাকুরের কাজকর্মের সাথে পরিচিত হবেন। যেমন, লন্ডনে চিত্রপ্রদর্শনীর পর পরই ওকাম্পোকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘…এ যেন সেই ডেড সী-র ভারি জলের মতোÑ সব কিছুই ভেসে থাকে যেখানে, তার ওজন যাই হোক না কেন। তুমি কোথায় আছ জানি না, শুধু চাই ভারতবর্ষে তোমার সঙ্গে দেখা হোক’।
রবীন্দ্রনাথ যখনই তাঁর বিজয়াকে চিঠি লিখতেন, তখনই শান্তিনিকেতন ঘুরে যাবার কথা বলতেন।
১৯৩৪ সালের জুলাই মাসের একটি চিঠিতে লিখেছিলেন-
‘প্রিয় বিজয়া, সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাই তুমি তোমার ভ্রমণসূচীতে ভারতবর্ষে রাখো একবার, আমার নিজের জায়গা শান্তিনিকেতনে এসে আমাকে দেখে যাও। অসম্ভব কেন হবে? নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বছরের শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া খুব ভাল এখানে, এবং তোমাকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখবার চেষ্টায় আমার কোন ত্রæটি হবে না সে তুমি নিশ্চয় জানো।
সম্প্রতি সিলোনে তোলা আমার একটি ছবি তোমাকে পাঠাই, আশা করি তোমার হাতে পৌঁছুবে।
আমার ভালবাসাসহ,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
এখানে উল্লেখ্য, এ চিঠির নীচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভালবাসা’ লিখেছিলেন এবং সাক্ষর করেছিলেন বাংলায়। ওকাম্পো-রবীন্দ্রনাথের মধ্যে পত্র আদান প্রদান হয়েছে অনেক- নথি থেকে ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত ৩২টি, ১৯২৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ১৪টি, ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত ৬টি, আর ১৯৩৯ সাল থেকে রবিঠাকুর মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ৮টি চিঠির কথা জানা যায়। আর ওকাম্পোকে লেখা রবিঠাকুরের বহু চিঠিতেই এভাবে বাংলায় লেখা ‘ভালবাসা’র হদিস মেলে। কখনো রোমান হরফেও ‘ bhalobasha ’ লিখে চিঠি শেষ করতেন রবিঠাকুর। এখানে একটি ব্যাপারও বলা দরকার, তাঁর দীর্ঘ জীবনে ওকাম্পোই কেবল একমাত্র ‘অনুরাগী বিদেশিনী’ ছিলেন না। বিশ্বভ্রমণে তিনি বহু নারীর সংস্পর্শেই এসেছিলেন; কারো সাথে সখ্যতা হয়েছে, কারো সাথে বন্ধুত্ব, আঁদ্রে কার্পেলেসের মতো কারো সাথে জীবনভর চিঠি চালাচালি করে রঙ্গ-রসিকতা করেছেন, কিন্তু ওকাম্পোর মতো কাউকেই ‘ভালবাসা’ সম্বোধন করে চিঠি শেষ করেননি তিনি।
কবি, অনুবাদক, ভ্যাঙ্কুভার, কানাডা
তথ্যঋণঃ
১) ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ- শংখ ঘোষ
২) In Your Blossoming Flower Garden- Ketaki Kushaari Dyson
৩) উপলব্ধির উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো-কবিতা চন্দ
৪) কবিমানসী (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড)- জগদীশ ভট্টাচার্য
৫) গানের পিছনে রবীন্দ্রনাথÑ সমীর সেনগুপ্ত
৬) রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানেÑ কেতকী কুশারী ডাইসন