জানালার শার্সির খোলা অংশ দিয়ে বাইরের দিকে চেয়েছিলো সে, একটা ন্যাড়া ছাদের কিনারহীন সিঁড়ি বেয়ে ওঠে কিশোরী, পাট করা শাড়ি হাতে ধরে সাবধানে। কল্পনার অ্যাকারিয়ামে হাতড়ে সে দেখতে পায় একটা বহুতল ভবন, উপরতলা থেকে পলকা পালকের মতো ভেসে ভেসে পড়ছে এক নারী, বিপ্রতীপ হাওয়ায় উড়ে উড়ে খুলে যাচ্ছে আঁটসাঁট সিনট্যাক্সে পরা লাল-শাড়ি, বেরিয়ে আসছে খোলস।পাশের বড়ো বাগানে গাছেদের মধ্যে সবচেয়ে লম্বা বাদাম গাছটাতে পাখিদের নিয়মিত সমাবেশ- বড়ো পাতাটার নিচ থেকে হাত মেলে বাতাসে শরীর ছেড়ে দিয়ে উড়ে আসে কালচে ধূসর পালকের দোয়েল- শার্সির খোলা অংশের উপরে বসে- তার চোখের দিকে তাকালে দেখা যায় কি কালো! কি গভীর!- সেই চোখ; পঁচা ডোবার শান্ত নিরব জলের মতো ভেতরের কালো শরীরে কি আছে ওপর থেকে দর্শকের কাছে বিরাট ধাঁধা- তবু সেই আগাধ রহস্যমণ্ডলীর ভেতরে ডুব দিয়ে সে দ্যাখে- কালো কালো কাজলে ড্যাবড্যাবে দুই চোখ এক নারীর! তার পাশে বরষার আন্দোলিত তালে তালে প্রদীপের দইসার মৃদুস্বরে কেঁপে ওঠা শরীর থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসা আলোয়, প্লাক করা ভ্রুর নিচে মরা নদীর অসহায় বালুর মতো চিকচিক করে চিৎকার করে চোখের নিবিড় পাতায় বর্ণিল আইশ্যাডো।
এইসব বহুমুখী ভাবনায় দাড়ির মতো ছেদ টেনে অস্পষ্ট ল্যাপস করে চলে আসে সেই এক, একই দৃশ্য- একটা বহুতল ভবন, সেখান থেকে বাতাসের শরীর চিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ একটা শরীর, লাল শাড়ি হাওয়ায় খুলে খুলে বেরিয়ে আসছে একটা অমল সাদা বরফিলা শরীর, শঙখ স্তন জোড়া- পলকা শরীর অথচ মাকড়ের মতো নয়, বৃথা দোয়েলের মতো, ফড়িং এর মতো ওড়ার চেষ্টা করে হাতগুলো দুইপাশে মেলে ধরে। গারদের অস্পষ্ট ভাবনার মতো দেয়াল তুলে সেইসব বন্ধ দৃশ্য লুকিয়ে রাখা যায় না, চুপ করে থাকে না- নিচের রাস্তা দিয়ে একটা লাল মারুতি, অবাধ্য গতি, সোঁ করে চলে যায় হাওয়ার বুক করে ফাঁক- এক যুবক লাল পাঞ্জাবি, কিশোরী লাল ফ্রক, আকাশে মেঘেরা কমলা-লাল থেকে লালচে সিঁদুর হয়ে ওঠে- আরোতো কমলা, সবুজ, হলুদ, জলপাই কতো রঙ ছিলো দুনিয়ায়!
বিছানার শাদা শাদা কাভারে মোড়ানো বালিশ, চাঁদর যা মাঝেমধ্যে টকটকে রক্তের মতো লাল মনে হয়- তার শুভ্র-সফেদ কাফন জড়িয়ে কবরে নামানো মূর্দা শরীরের মতো ফাইবারে রোদ এসে পড়লে- সে হাতের সফেদ অথচ রেখাবহুল মুঠি মুঠ করে আটকে দিতে চেয়েছে বহুবার- রোদ ধরে নিতে, পারেনি বের হয়ে এসেছে কিভাবে, অচেনা উপায়ে- যেমন শরীর থেকে নিরবে বের হয়ে আসে প্রাণ, শরীর থেকে কোন রাস্তায় বের হয়ে আসে পৃথক কোনো আবরণে করে তাকে সংরক্ষণ করা যায় না ফরমালিনের মতো কোনো প্রিজারভেটিভে। অথচ একই শরীরের ভিতর বাঁচা যেতে পারতো দুটো আস্ত প্রাণ নিয়ে। এইসব দেখতে দেখতে সেই দোয়েল তার সরু রোগা দুই ঠ্যাং ছুঁড়ে ছুঁড়ে ঢুকে পড়ে জানালার ভিতর দিয়ে। ডেস্কের পাশে শুকনো কড়কড়ে ভাত যা মূলত শুকিয়ে আবার চাল হয়ে গ্যাছে অনেকক্ষণ, বস্তুত দেখে মনে হচ্ছে গত কয়েকরাত আগের ডিনারের অথবা বমিতে উগড়ে দেয়া আধাহজম হওয়া ভোঁতা ভোঁতা ভাত- ঠুঁকরে ঠুঁকরে খাচ্ছে কালো-ধূসর শরীরের পাখি।
এখান থেকে দেখলে মনে হয় একটা খাঁচার মতোই ঘরটা- খাচার বাইরে থেকে সব খাঁচা আলাদা, ভিতর থেকে একই লাগে সব- সুবিশাল খাঁচা, অবিশাল খাঁচা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খাঁচা, আলিশান খাঁচা, সংকীর্ণ খাঁচা- মানুষের বাসযোগ্য ঘরগুলো কেন যেন খাঁচাই মনে হতে পারে- আকাশ ই একমাত্র খোলা- আকাশের কোনো খাঁচা হয় না, এই যে আকাশ কাশ্মীরের আকাশও তাই, যেন এমনই অবিরল আজাদী নিয়ে বিস্তৃত বিস্তার। যেন কাশ্মীরের ধূসর কুয়াশা শরীর, মিনারের উপর থেকে উড়ে যায় স্বাধীন প্যারাট্রুপ বাহিনীর পরাধীন সব উড়ুক্কু জাহাজ, উড়োজাহাজ- সেই আকাশ, সেই স্বাধীনতার ঘ্রাণ- অথচ জমিনে স্বাধীনতার বাটোয়ারা আছে। রাজনীতি চিরকাল বিভেদের দেয়াল তুলে দেয়, বার্লিন দেয়ালের মতো সেঁটে দেয় মানুষের বদ্ধ শরীর, লটকে দেয় বৃদ্ধ মগজের মটকায়। স্বাধীনতার চিন্তার সাথে সাথে গোপনেই লোভী হাত ব্রেক কষে কষে যেতে থাকে দোয়েলের রোগা, আকাশের স্বাধীনতায় চুপচুপ আহাররত শরীরের দিকে, আচমকা এইসব ভাবনার ভিতর ছেদ টেনে কোনোমতে ডানায় ভর দিয়ে ফিক শব্দ করে উড়ে যায় দোয়েল, সার্সির বাইরে-অবিশ্বাস!
অহরহ সেই এক দৃশ্য ভেসে আসে চিন্তায়, সবকিছু লাল হয়ে আসছে চোখের সামনে। পাতার মরশুমে পাতাদের স্মৃতি মনে আসে না, মনে পড়ে হেমন্তের পাতাদের কবরের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে, পাতাদের ভেঙে চুড়ে গুড়িয়ে আসা শরীরের মর্মরে- যেতে যেতে শরীর ম্লান হয়ে আসে অবসাদ-এংক্সাইটি; মৃত্যুর ডাক নিয়ে এম্বুলেন্সের আসা যাওয়া দেখলে যেমন হুট করে সাইকেল ঘন্টির মতো আপনজনের স্মৃতি মগজে বেজে ওঠে- তবু এইসব এলিগোরি, শোকবার্তা কোনোকিছুই অসার ভোঁতা অনুভূতিতে দাগ দিতে পারে না, শুধু একটা দৃশ্য পুনঃধারাবিবরণীর মতো রেটিনায় ঝিল্লীবত লেগে থাকে ‘একটা বহুতল ভবন, উপর থেকে পড়ে যাচ্ছে একটা লাল শাড়ি ও শরীর, ক্রমশ পোশাক খুলে বের হয়ে যাচ্ছে খোলস, কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই- যেন বারবার হাত নেড়ে উড়ে ভেসে থাকতে চাইছে পতঙ্গিনী শরীর- ব্রাকগ্রাউন্ডে কোনো ব্যস্ততা নেই, কোনো সৌন্দর্য নেই, কোনো নন্দনতত্ব নেই- কোনো কবিতা পাঠ নেই, শেষ যাত্রার ধ্বনি নেই, কোনো অর্কেস্ট্রা, করুন ভায়োলিন সুর- বাস্তবে কোনো আকাশ নেই মাথার উপর, স্বাধীনতা নেই কল্পনায়।
এতো এতো ভাবনার ভিতরে এইমাত্র এর আগে কি ভাবলো তাই ভুলে যেতে হয়,একটু থেমে মনে করে নিতে হয় কি ভেবেছিলো? এইতো এইমাত্র, জল খাওয়া? পানির গেলাসটা গলা অবধি জল গিলে ঢাকা দিয়ে আছে-ওষুধ?- না, না আর খাবে না- ভীষণ রকম বিশ্রী মাথা ভোঁভোঁ করে সব মুছে যায় সামনে থেকে লাল-নীল-সাদা সব রুগ্ন পৃথিবী সামনে নিউক্লিয়ার উইন্টারের পাতা মেলে ধরে যেন। এইভাবে ভুলে যেতে হয়, তবু এই ভুলে থাকা শৌখিন পশমে মুখ গুঁজে ভুলে থাকা নয়, কলকব্জা সব খিচে আসে- আবার অস্পষ্ট করে জুড়ে যেতে শুরু করে ভাঙা যন্ত্রাংশের মতো এক এক করে- চোখের সামনে ‘সেই বহুতল ভবন থেকে পালকহীন সারসের মতো পড়ে যাচ্ছে একটা সাদা শরীর, লাল শাড়ির মোড়ক খুলে খুলে যাচ্ছে, বাতাসের রঙহীন সমুদ্রের ভিতর হাত নেড়ে তল পেতে চাইছে একটা নারী শরীর- ছাদে বসে সেই দিকে অসহায় মাছের মতো চোখ খুলে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে সে, যে অব্দি শরীরটা মাটিতে পড়ে ভেঙেচুরে যেতে চায় মনের মতো…’ চিন্তার ভিতরে ছেদ চলে আসে- সামনে নার্স হাতে ওষুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে…।