ঠিক আছে, তুমি কোলকাতায় এলে তোমাকে বকুল দিয়ে বরণ করে নিবো। এখন সব ফুল আমি শুকিয়ে রাখবো। তুমি কবে আসবে? চলে এসো না মেমসাহেব! নীলের এই অসহায়ত্ব অনন্যাকে মর্মপীড়া দেয়। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগে। কিছুই আর বলতে পারে না সে।
সেদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায় অনন্যার। ছুটির দিন এত ভোরে বিছানা ছেড়ে ওঠে না সে। পাড়া প্রতিবেশীরাও ওঠে না। রাস্তাঘাটও জাগে না। সেভেন ক্রিসেন্টের ৫০৮ এর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অনন্যা। ভোরের উদাস মন নিয়ে সুদূরে দৃষ্টি মেলে দেয় সে। সামনে সুশোভিত ডেন্টনিয়া পার্ক। সেই পার্কের অকৃপণ সুন্দর আজ ধূসর অনন্যার কাছে। জনমানবের চলাচল শুরু হয়নি তখনও। ডেন্টনিয়াপার্ক থেকে ড্যানফোর্থের দিকের রাস্তাটি একেবারেই ফাঁকা। ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকার এমন নির্জনতা এর আগে দেখেনি অনন্যা। ঠিক যেন তার শূন্য হৃদয়ের মত হাহাকার তুলছে ড্যান্টোনিয়া পার্কের গাছপালা, বসার বেঞ্চি, ভলিবলের কোট, নেট- সব!
নীল ছোটবেলা থেকেই একটু অসুস্থ। এরই মধ্যে হার্টের অপারেশন হয়েছে। তাই, মানসিক শক্তি তার আর পাঁচজনের মত নয়। হৃদয় তার সংবেদনশীল, দয়ামায়ায় ভরা মন। ভীষণ আবেগপ্রবণ। তাই, অনন্যার প্রতি তার আবেগ ঝরে পড়ে কথায় কথায়।
একদিন রাতে ফোন করে নীল। অনন্যার কাছে কাতর হয়ে আদর চায়। একলা বিছানায় অশান্ত হয়ে ওঠে সে। কিন্তু, তখন যে অনন্যার দুপুর। অনন্যা কাজে ব্যস্ত। শনি- রবিবারগুলোতে লন্ড্রি রুমের ওয়াশার এবং ড্রায়ারগুলোর অবসর নেই। মোটামুটি কিউতে দাঁড়িয়ে থেকেই পেতে হয় মেশিনগুলো। অনন্যার প্রচুর কাপড় জমেছে। সেগুলো না ধুলেই নয়। শনি- রবি বাদে বাকি পাঁচ দিনই অফিস তার। সে দিন গুলোতে নাকেমুখে কিছু খেয়ে, রেডি হতে হতেই নাভিশ্বাস!
কানাডার যান্ত্রিক জীবনে নিচ্ছিদ্র ব্যস্ততা অনন্যার। তারই মাঝে ওই একটু স্বস্তি আর ভালো লাগা তার নীলকে নিয়েই। নীলের সাথে কথা বলার পর পরিশ্রান্ত শরীর মন আবার চাঙা হয়ে ওঠে অনন্যার। কিন্তু, আজ যে উপায় নেই কথা বলার। নীলকে বুঝিয়ে বলার মত কথা সে বলেছে। কিন্তু, নীল তা গ্রহণ করতে রাজি নয়। নীল বললো – আধ ঘন্টায় কি এসে যায় মেমসাহেব? একটু আদর করো না আমায়!
অনন্যা তার সময়ের বেগতিক দেখে ইন্টারনেট লাইন অফ করে নিচে চলে যায়। নীল খুব কাঁদে সেই রাতে। বিড়বিড় করে বিলাপ করে- মেমসাহেব, তুমি চলে এসো। চলে এসো তুমি কোলকাতায়। নাহয় তোমার ঢাকায় চলে এসো। ক্ষণকাল পড়ে নিথর হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে নীল।
সেদিনের পর অনন্যা ফোন করলে নীল রিসিভ করে না। বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে এমন। অনন্যা ম্যাসেজ, ফোন করেই যাচ্ছে। what’s App এও কোনো সাড়াশব্দ করে না নীল, ম্যাসেঞ্জারের ম্যাসেজও দেখে না সে।
বেশ কিছুদিন চলে যায় এভাবেই। একদিন নীল খুব মেজাজ খারাপ ক’রে অনন্যাকে উত্তর পাঠায়। লিখে- আমি মেন্টালি খুব খারাপ আছি। তুমি তো জানো বিভিন্ন অসুস্থতার পর ডাক্তার আমাকে কোনো নেগেটিভিটির মধ্যে যেতে নিশেধ করেছেন। তোমার মধ্যে আমি তেমন পজিটিভ চিন্তাভাবনা দেখিনা আমাকে নিয়ে, যা আমাকে ভালো রাখতে পারে। আমি কিছুদিন একা থাকতে চাই। প্লিজ, তুমি আর আমাকে লিখো না। আমি মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছি। So, leave me, please.
অনন্যা সেদিন অপমান বোধ করে। ভীষণ অভিমান হয় তার। তবুও, নীলকে সে ভুলতে পারে না। ভালোবাসা ভুলতে চাওয়ার মত বোকামী আর হয় না। ভালোবাসার নিজস্ব একটি গতি আছে। ঘূর্ণিঝড়ের মতই সে গতি। আছড়েপিছড়ে নিজে থেকেই দুর্বল হয়ে যায়। কিন্তু, অনন্যা নীলকে ভুলতে চেষ্টা করে। যত চেষ্টা ততোই কষ্ট খামচে ধরে অনন্যকে।
এরই মধ্যে অনন্যার পি আর কার্ড চলে আসে। অনন্যা মাস্টার্সের জন্য কানাডা গিয়েছিলো, কো আপ প্রোগ্রাম সহ। সেই কাজটিই এখন স্থায়ি চাকরি তার। চাকরি খোঁজার যন্ত্রণা আর পোহাতে হয়নি তার। পি আর হওয়ার প্রায় এক বছর পর অনন্যা দেশে আসে। বাবা- মা’র ভীষণ পিড়াপিড়িতে হার মানে অনন্যা। নাহয় মনের দিক থেকে তখনো সে ভঙ্গুর!
অনন্যা খুব ছোটো ছুটি নিয়ে ঢাকায় আসে। এরই মধ্যে শুরু হয় করোনা মহামারি। কানাডা সরকার তার দেশের সব সিটিজেনদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেও অনন্যার মন চাইলো না এই মুহুর্তে সবাইকে ছেড়ে যেতে। বেশ কয়েক মাস হয়ে গেলো অনন্যা ঢাকায়।
চলবে…..