সবিতা সোমানী
একটি মেয়ের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, জীবনযাপন সবই নির্ভর করে সমাজ ও পরিবারের গঠন এবং সমাজে বিদ্যমান সংস্কৃতির উপর । আমাদের মতো পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়ের জন্মের সাথে সাথেই তাকে শেখানো হয় তুমি দুর্বল, যা তাকে পরনির্ভরশীল করে তোলে। তাকে উঠতে-বসতে এটাই শেখানো হয়, তুমি একটা মেয়ে এবং তাকে নানাবিধ সমাজের তৈরী নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে।
যেমন মেয়েদের জোরে কথা বলতে নেই, এভাবে কাপড় পড়তে নেই, এভাবে চলতে নেই ,এভাবে ভাবতে নেই, শুধু নেই আর নেই। তাকে হতে হবে নরম শরম , সে কোনো প্রতিবাদ করবে না ,তার কোনো আত্মসম্মান থাকতে পারবে না ,তার কোনো রাগ থাকবে না , খুব বেশি হলে অভিমান থাকতে পারে সে হবে সর্বংসহা, যার সহ্যশক্তি হতে হবে অসীম, পরিবারের মান-সম্মানের ভার শুধু একা তার।
সে আজীবন সংসারের সকল দায়িত্ব পালন করবে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। শুধু কি তাই, তাকে শেখানো হয় বাহ্যিক সৌন্দর্য বা চেহারাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং তার মূল্য তার চেহারার অথবা বাহ্যিক সৌন্দের্যের সাথে জড়িত। কিন্তু আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি , আমাদের এসব কথা বার্তা কতটা ক্ষতি করছে মেয়েটির ।
বাচ্চারা সহজেই তারা তাদের লিঙ্গ সম্পর্কীতো কথাগুলি শুনতে শুনতে তা বিশ্বাস করতে শুরু করে, যা তার ভবিষ্যৎ জীবনের কর্মক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। এই মেয়েগুলি ভবিষ্যতে ক্লাসে প্রশ্ন করতে ভয় পায়, কর্মক্ষেত্রে প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না , এমনকি তাদের ব্যক্তিগত জীবনেও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে না , শুধু শিখে তার একান্ত সঙ্গীকে খুশি রাখতে হলে তাকে সুন্দর থাকতে হবে ,তার সবকিছু মেনে নিতে হবে , সংসার টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব শুধুই তার।তার চেহারা আর শারীরিক সৌন্দর্যই আসল ,তার বুদ্ধিমত্তা ,তার লেখাপড়া,তার অন্য সব গুন্ ই হচ্ছেই সেকেন্ডারি। তাই বাবা মা হিসেবে আমাদের সচেতন হতে হবে যেন আমাদের মন্তব্যগুলো অনিচ্ছাকৃতভাবে আমাদের সন্তানের ক্ষতি না করে।
১/আপনার মেয়েদেরকে “সুন্দর হতে শেখাবেন না।” আপনার মেয়েকে শেখান যে সে সুন্দর,তার চেহারা বা পোশাকের কারণে নয়। সে সুন্দর কারণ সে স্মার্ট, সে ইন্টেলিজেন্ট, সে কাইন্ড ইত্যাদি কারণে।
২/ আমাদের মেয়েদের যেমন সত্য ও বিনীত হতে শেখাবেন , তেমনি তাকে বলুন যে সেও অন্যের সদাচরণের প্রাপ্য। তাকে বলুন যে কোনও কিছু যদি তাকে কখনও অস্বস্তিতে ফেলে তাহলে সে যেন তা বলে , জোর গলায় বলে ।
৩/কখনোই কোনো ছেলের অপরাধ এই বলে ছোট করে দেখবেন না যে ছেলেরা এমনি হয় .বরং কোনো ছেলে অন্যায় করলে , আপনার মেয়েকে বলুন প্রতিবাদ করতে , বলুন এই ধরণের ব্যবহার গ্রহণযোগ্য নয়।
৪/মেয়েকে শিখাবেন, সে ভালো ক্যারিয়ার এবং ভালো পরিবার, দুটোই চাইতে পারে। কেউ যেন তাকে একটির দিকে ঠেলে দেয়ার সুযোগ না পায়। পুরুষের ক্ষেত্রে কিন্তু এটা তেমন একটা হয় না যে, হয় তুমি সংসার করো, নয় কাজ করো। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এটা প্রায়ই ঘটে, এব্যাপারে তাকে সচেতন করবেন ।
৫/কতটা ছাড় দিব, আর কোথায় নিজের সিদ্ধান্তের সপক্ষে শক্তভাবে দাঁড়াব, এটা খুব ভালোভাবে নির্বাচন করতে শিখাতে ছোটবেলা থেকেই।আরো শেখাতে হবে কাউকে শুধুমাত্তর খুশি করার জন্য নিজের অধিকার ও ইচ্ছাকে বিসর্জন দেয়াকে উদারতা বলে না।
৬/আমাদের মেয়েদের শিখাতে হবে মধুর স্বভাবের হওয়া এবং ভয়ে জড়োসড়ো থাকার মাঝে পার্থক্য আছে। কাউকে ‘না’ বলা অভদ্রতা নয়। বরং আসল অভদ্র লোক হলো তারাই যারা আশা করে মেয়েরা তাদের শরীর ও মনের উপর নিজের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে ছেলেদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবে।
সবশেষে বাবা-মাকে বলবো আসুন আমরা সবাই সন্তানের কথা শুনি মনোযোগ দিয়ে। অবহেলা করবেন না।তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করি আর প্রতিবাদী করে গড়ে তুলি।তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করি।