রেজাউল ইসলাম
একটি মহামারী পৃথিবীকে কতটুকু অসহায় করে দিতে পারে তা নিজের জীবনে দেখার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে হবে তা কখনই ভাবিনি।মার্চ মাস থেকেই কানাডাতে এক মহামারীর আবির্ভাব ঘটে ।এই মহামারীর নাম করোনা ভাইরাস। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মার্চ মাসের অনেক আগে থেকেই সতর্ক বার্তা দিয়ে যাচ্ছিল এই ভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে।চীনের উহান থেকে এর উৎপত্তি।প্রথমে উহান , এর পর একে একে সারা বিশ্বে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। আমার যতদূর মনে পড়ে, প্রাইমিনিস্টার জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী সোফি গ্রেগর ইংল্যান্ড থেকে আসার পর তার করোনা ভাইরাস পজেটিভ ধরা পড়ে ।সেই সময় জাস্টিন ট্রুডো নিজেকে স্বেচ্ছা অন্তরীন ঘোষণা করেন।এর পর থেকে কানাডাতে আস্তে আস্তে এই ভাইরাস বাড়তে বাড়তে এক ভয়াবহ আকার ধারন করে।
এক পর্যায়ে সরকার থেকে প্রয়োজনীয় ছাড়া অন্য সকল কাজ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা আসে। সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়।বার, রেস্টুরেন্টের ডাইনিং বন্ধ করে দেওয়া হয়।বড়,বড় শপিং মলের ক্যাপাসিটি কমিয়ে সীমিত আকারে চালু রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। পার্ক,জিম, রিক্রিয়েশনাল সেন্টার/ক্লাব বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রয়োজন ছাড়া নাগরিকদের ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়।এই সময় প্রথম প্রথম রাস্তা-ঘাটগুলিতে রাতের বেলা জনমানবহীন এক ভূতুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। রাস্তাগুলি খা খা যানবাহন শূন্য থাকতে দেখা যায়।
সেই মার্চ থেকে এই পর্যন্ত স্বাভাবিক জীবনের গতিময়তায় ছেদ পড়ে। ভাইরাস থেকে বাচার জন্য মানুষ বেশির ভাগ সময় ঘরেই সময় কাটাতে থাকে। মানুষের জীবন-যাপন হয়ে উঠে চার দেয়ালের মধ্যে বন্ধী।প্রয়োজন ছাড়া মানুষ খুব একটা বাইরে যেতে আর আগ্রহীবোধ করে না।
আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটির উপর এই মহামারীর সুগভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।বিশেষ করে বাঙ্গালীদের প্রানকেন্দ্র বাংলা-পাড়ায় প্রাণচাঞ্চল্য অনেকটাই স্থিমিত হয়ে পড়ে। যেখানে প্রায় প্রতিদিন কোন কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো সেখানে তেমন কোন অনুষ্ঠান হতে দেখা যায় না। যেখানে বাংলা-পাড়ায় ঘরোয়া, সুইসে প্রতিদিন বাঙ্গালীরা আড্ডাবাজীতে মেতে থাকতো সেখানে নেই কোন আগের মত প্রানোচ্ছাস।এইবার পহেলা বৈশাখ উজ্জাপিত হয়েছে প্রানহীনভাবে।স্বাধীনতা দিবসে ছিলনা কোন অনুষ্ঠান।এই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে ভার্চুয়াল জগত ছাড়া কোথাও ছিলনা কোন আয়োজন।
অন্যদিকে, ভাইরাসের সাথে লড়াই করা ছাড়াও এখানকার বাংলাদেশীরা জীবন যাপনের লড়াইয়েও আবতীর্ন হয়েছে।অনেকেই কাজ থেকে সাময়িক লেইড-অফ হয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা হারিয়েছে।আবার অনেকে স্থায়ী চাকুরী হারিয়ে বেকারত্বের কঠিন যাতাকলে পড়ে নাভিশ্বাস উঠেছে।অনেকেই কোনরকমে হয়ত সরকারের আর্থিক সাহায্য নিয়ে টিকে আছে।যাদের বাড়ী আছে তাদেরকে মর্টগেজ ম্যানেজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে।কর্মহীন হয়ে অনেক বাংলাদেশী তাদের এপার্টেমেন্টের রেন্ট দিতে পারছে না।জীবন যাপনের ব্যয় মিটাতেই অনেককে পড়তে হচ্ছে নির্মম অবস্থার মধ্যে।
যাদের বয়স কম তারা সব চেয়ে বেশি হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে। তাদের সোস্যালাইজেশন বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ না হওয়ায় একধরনের একাকীত্ব তরুণ-তরুনীদের গ্রাস করেছে। কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বন্ধু-বান্ধবদের সাথে স্বাভাবিক tie নষ্ট হয়ে গেছে।অনেকেই চরম হতাশার সাগরে ডুবে গেছে। তাদের মনোজগতে এক দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলছে এই কোরোনা ভাইরাসের উপস্থিতি।প্রাণোচ্ছল জীবনে নেমে এসেছে গভীর হতাশা।
এই সামারে যেখানে বাঙ্গালীদের ঘরে ঘরে পার্টি হতো , নানা রকম গ্যাদারিংয়ের ব্যবস্থা হতো , সেইগুলিও ছিল না তেমন।বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া, পিকনিক, ক্যাম্প করে থাকা,পার্কে পার্কে বারবিকিউয়ের গ্যাদারিং ইত্যাদি সামারের বিশেষ আকর্ষণগুলি ছিল এবার একেবারেই ফিকে।যারা এই সামারে কানাডার বাইরে কোথাও যেতে প্ল্যান করেছিলেন তাদের সেই আয়োজনগুলি শেষমেশ পন্ড হয়ে গেছে ভাইরাসের আগমনে।
তবে এর মধ্যে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে একটি ভার্চুয়াল জগত গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশী কমিউনিটির বাসিন্দারা ভার্চুয়াল জগতে গান,কবিতা, আড্ডা ইত্যাদির আয়োজন করে দৈনন্দিন জীবনে কিছুটা প্রান সঞ্চারের চেষ্টা চলিয়ে যাচ্ছে।যাদের ফেসবুক আছে তারা এই সব আয়োজনের সাথে connected হয়ে ভার্চুয়ালি দেখা-সাক্ষাৎ, গল্প-গুজবে মেতে উঠেছে। এতে কিছুটা হলেও গৃহবন্ধী অবস্থার মধ্যেও তারা আনন্দ খুজে পাচ্ছে।অন্তত একজন আরেকজনকে দেখতে পাচ্ছে,কথা বলতে পারছে।এই connectivity তাদেরকে অনেকটাই হতাশার চরম অন্ধকারে আলো দিচ্ছে।
তবে এর মধ্যে কিছু ভালো কাজও হয়েছে। অনেক সংগঠন,ফেসবুক গ্রুপ মানবিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এসেছে। এই সংগঠন,গ্রুপগুলি কোরোনাকালে অনেক কোয়ারেন্টিন পরিবারকে তাদের দোরগোড়ায় গ্রোসারী, খাদ্যসামগ্রী এবং ঔষদ পৌঁছে দিয়েছে।বিভিন্ন প্রকার প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সবাইকে জানতে সাহায্য করেছে,সতর্কতা সৃষ্টি করেছে।এই মানবিক কাজগুলি এখনো অব্যাহত আছে।
এই বছরের সবচেয়ে করুন এবং ব্যথাতুর ঘটনা ছিল, অনেক বাংলাদেশী কোরোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যবরন করেছে।তাদেরকে কবরস্থ করা হয়েছে খুব সীমিত আয়োজনে।প্রিয় মানুষটি আক্রন্ত হবার পর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আর প্রিয়জনদের সান্নিধ্য পান নি।অনেক পরিবার প্রিয়জন হারিয়ে দিশেহারা।অনেক পরিবার হয়ত সেই ব্যক্তিটির উপর নির্ভরশীল ছিল।পুরো পরিবার সেই আকৎসিকতায় পর্যদুস্ত।
এইভাবেই এবার একটা দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে ২০২০ সাল চলে গেল।সবার জীবনেই এই সালটি একটি বিভীষিকাময় সাল হিসাবে চিরজীবন থেকে যাবে।নতুন ২০২১ সাল হয়ত আবার নতুন আশায় পথ চলার শক্তি যোগাবে।দেশে দেশে কোরোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন ইতিমধ্যে চলে আসা শুরু করেছে।কানাডাতেও ফাইজার, মডার্নার ভ্যাক্সিনের সিপমেন্ট এসে পৌঁছেছে।আরো অনেক সিপমেন্ট আসার অপেক্ষায়। নাগরিকদের মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে দেওয়াও শুরু হয়েছে গেছে।সাধারণ নাগরিকরা হয়ত জুলাই থেকে ভ্যাক্সিন পাওয়া শুরু করবে। আশা করা যায় ৮০%-৯০% নাগরিক ভ্যাক্সিনের আওতায় চলে আসলে এই ভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়বে। আগামী স্প্রিং নাগাদ আমরা হয়ত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবো।আবার আমরা স্বাভাবিক ভাবে বাধা-বন্ধনহীনভাবে চলাফেরা করতে পারবো। আবার আমরা বাংলা পাড়ায় আগের মত মিলিত হবো, আড্ডা দিবো। হবে আগের মত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।দুর্দিন চলে গিয়ে সুদিন আসবেই।মেঘ কেটে গিয়ে সূর্যের দেখা মিলবেই।