শাহেদ ইকবাল
বঙ্গবন্ধু শুধু একটি নাম নয়, শুধু একটি বিশেষণ নয়, শুধু একটি শব্দ নয়। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মানে মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু মানে লাল-সবুজ পতাকা। বঙ্গবন্ধু মানে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। বঙ্গবন্ধু মানে বাঙালির বর্ণমালা। বঙ্গবন্ধু মানে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। বঙ্গবন্ধু মানে বাংলা ও বাঙালি।
জন্ম যার ব্রিটিশশাসিত পূর্ববাংলার এক মধ্যবিত্ত জনপদে, তাঁরই দুর্জয় নেতৃত্বে ভেঙে পড়ল শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনের মসনদ। তাঁরই কণ্ঠে বেজে উঠল হাজার বছরের মঙ্গলকাব্য। তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে জেগে উঠল বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস। বিশ্বভূবন হলো পলকহারা, বাকরুদ্ধ। যে বাঙালি দিলীর সুলতানী আমলে, মোগল আমলে কিংবা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিদ্রোহ করেও স্বাধিকার ছিনিয়ে আনতে পারেনি, সেই বাঙালি যেন এক অলৌকিক বংশীবাদকের আহ্বানে স্বপ্নাবিষ্টের মতো জেগে উঠল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন ইতিহাসের সেই অলৌকিক বংশীবাদক। ইতিহাসের রাখাল রাজা।
ইংরেজ কবি ও প্রাবন্ধিক টি এস এলিয়ট (১৮৮৮-১৯৬৫) বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক জাতিকে মুক্তির দীর্ঘ প্রহর গুণতে হয়, একটি জাতির শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা পুরোনো প্রথা ভেঙে অবিস্মরণীয় দীপ্ত বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে এবং সে নেতৃত্ব একটি জাতিকে শৃঙ্খলমুক্ত করে।’ রুশ দার্শনিক প্লেখানভ (১৮৫৬-১৯১৮) মনে করতেন, ‘ইতিহাসের বিষয়বস্তু সাধারণ মানুষ হলেও ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক ও স্রষ্টা একক কোনো নেতা।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের সেই মহান নেতা। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা বা স্বাধীনতার চেতনার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। একমাত্র ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই রাষ্ট্রের স্থপতি। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিখ হেগেলের (১৭৭০-১৮৩১) ভাষায়, ‘মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।’ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ছিল ইতিহাসের অনিবার্য উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি থাকলেও তাঁর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকারও তাঁর নেতৃত্বেই গঠিত হয় (১৭ এপ্রিল, ১৯৭১)। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদারবাহিনীর আত্মসমর্পণ সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো রাষ্ট্র বা সরকার গঠন অসম্ভব ছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের পর বাঙালির নিরাপত্তার আশঙ্কা দূরীভূত হয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি Newsweek ম্যাগাজিনের ভাষায় ’Poet of Politics’ মুজিবের অমর কাব্য।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল নায়ক ও মূল প্রেরণা। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর পূর্বে কখনও এমন সর্বাত্মক সংগ্রাম ও বিজয় দৃশ্যমান হয়নি। অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমানের ভাষায়, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসের একমাত্র সফলতম আন্দোলনের নির্মাতাই ছিলেন না, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি সকল শহিদের ঋণ শোধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই ব্যক্তিত্ব, যাঁর জীবন ও কর্ম সফল করেছে ক্ষুদিরাম-প্রীতিলতা-সূর্যসেন থেকে সালাম-বরকত-রফিক কিংবা ঊনসত্তরের শহীদ আসাদের আত্মদানকে। তিনিই একমাত্র নেতা যিনি একইসঙ্গে বাঙালির অতীত ও ভবিষ্যতকে তাৎপর্যপূর্ণ করেছেন।’
১ মাহবুবুল আলমের ভাষায়, ‘নির্ভীক ও স্বপ্নের কারিগর বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে নির্মাণ করেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ও এর গৌরবদীপ্ত সাফল্যের ইতিহাস। তিনি ছিলেন রাজনীতির এক মহান কবি। যার ভাষণের পঙ্্ক্তিতে পঙ্্ক্তিতে ছিল কাব্যিক ব্যঞ্জনা, অনুপ্রাস ও মাত্রাবোধের এক অপূর্ব সম্মিলন।’
২ বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন উৎসারিত হয়েছিল গণমানুষের প্রতি অবিচল ভালবাসা ও আস্থা থেকে। তিনি সহজেই মানুষের হৃদস্পন্দন বুঝতে পারতেন। সর্বসাধারণের দুঃখবেদনা ও অভিলাষ প্রতিফলিত হতো তাঁর আজন্মলালিত জীবনদর্শনে। তিনি ছিলেন নীতি ও আদর্শে অটল, লক্ষ্যে অবিচল, ত্যাগ ও অধ্যবসায়ে নিরলস। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা, আত্মপরিচিতি ও মূল্যবোধ উন্মোচিত হয় তাঁর বিরচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র প্রথমভাগে বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি আছে। ১৯৭৩ সালের ৩ মে তারিখে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেনঃ
‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্প্রীতির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’
৩ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহানের ভাষায়, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন নেতার ভাষণ আমি যখন পড়ি এবং তাঁদের ভাষণের সঙ্গে যখন আমি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তুলনা করি, তখন আমার কাছে তাঁর একটি অভিব্যক্তি, ‘জনগণের প্রতি ভালোবাসা’, তা অনন্য বলে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের জন্য তাঁর যে ভালোবাসা এবং প্রতিদানে জনগণের যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, তার কথা তিনি নানা ভাষণে বারবার ব্যক্ত করেছেন।’
৪ ইংরেজিতে একটি কথা আছে, `True love comes back’। বঙ্গবন্ধুর বেলায় এটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। তিনি ভালোবেসে ছিলেন বাংলার মানুষকে। বাংলার মানুষ সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছিল। তাঁর ভালোবাসার এমনই সম্মোহনী শক্তি ছিল যে, মানুষ তাঁর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং অকাতরে জীবন দিয়েছিল। মানুষের ভালোবাসা ছাড়া তাঁর আর কোনো অভিলাষ ছিল না। না রাজ্য না রাজত্ব। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির শুরুতেও ছিল মানুষ, শেষেও ছিল মানুষ। তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের কেন্দ্রে ছিল শুধু মানুষ আর মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টেলিভিশনের ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তা প্রচারিত হয়। উক্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস।….আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কিছু দাবি নেই। তারা আমাকে ভালোবেসেছে। সবকিছুকে বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সবকিছুকে তাদের জন্য দিবার অঙ্গীকার করেছি। আজ আমি তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। আমি যখন আমার প্রতি দেশবাসীর স্নেহ-ভালোবাসার কথা ভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।’
সেই সাক্ষাৎকারে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, জনতার প্রতিই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি তো জানি, আমি অমর নই। আজ, কিংবা কাল, কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। মানুষ মাত্রই মরতে হয়। কাজেই আমার বিশ্বাস, মানুষ মৃত্যুবরণ করবে সাহসের সাথে।’
১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ নিজের জন্মদিনে জনগণের ভালোবাসা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দেশবাসীর ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।’
ভালোবাসা আসে ঈশ্বর থেকে। ভালোবাসার যেখানে শুরু, অমরত্বেরও সেখানেই শুরু। মানুষ জীবদ্দশায় এই অমরত্ব দেখতে পায় না, মৃত্যুর পর দেখতে পায়। বঙ্গবন্ধুর বেলায়ও এমন হয়েছে। তিনি যখন মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন, তখন থেকেই তাঁর অমরত্বের শুরু। ঘাতকেরা তাঁর বাইরের মূর্তিটাকে হত্যা করলেও ভেতরের প্রেমিকসত্ত্বাকে হত্যা করতে পারেনি। বরং মৃত্যু তাঁকে পূনর্জন্ম দিয়েছে নব নব রূপে, নব নব শক্তিতে।
বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার এই প্রচণ্ড শক্তি বোঝা গেছে ১৯৭৫-এর পরে। তাঁর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পর সময় যত গড়িয়েছে, ততই তাঁর ভালোবাসার শক্তি আরও তীব্র হয়েছে। মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়েও বহুগুণে শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছেন। কমরেড চে গুয়েভারার রক্তের ওপর দিয়ে যেভাবে বলিভিয়ায় সমাজতন্ত্র এসেছে, সেভাবেই ১৫ আগস্ট আরেকটা জন্মদিন হয়ে সকল ঘাতকচক্রের মরণঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে লাল-সবুজের বাংলাদেশের সকল অর্জনে বঙ্গবন্ধু অন্য ভূবন থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বিশ্ব ইতিহাসে বিভিন্ন জাতির ক্রান্তিলগ্নে সময়ে সময়ে মুক্তির ত্রাতা রূপে মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে। এছাড়াও আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে আমরা দেখি জাতিরাষ্ট্রের ধারণা বিস্তৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেতা একটি জাতি কিংবা দেশের জনগণকে মুক্তির পথে চালিত করেন। এর সঙ্গে আমরা দেখি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা অনেক নেতার কথাও উল্লেখ করা হয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে বলেছিলেন- ‘আজ আশা করি আছি পরিত্রাণ কর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দরিদ্র লাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দ্বৈববানী সে নিয়ে আসবে। মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্ব দিগন্ত থেকেই।’
যদিও রবীন্দ্রনাথ কথাগুলো বলেছিলেন ব্রিটিশ শাসকচক্রের ভারত সাম্রাজ্য ত্যাগের উদ্দেশ্যে, কিন্তু তাঁর এই উক্তিটি বিস্ময়করভাবে মিলে যায় পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগের ক্ষেত্রেও। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পূর্ব দিগন্তের সেই মহান পুরুষ আর কেউ নন-স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা বার্ষিকী উপলক্ষে বেতার-টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ আমরা বিশ্ব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে আমরা বিভোর, একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রুতিতে আমরা অটল। আমাদের সমস্ত নীতি, আমাদের সমস্ত কর্মপ্রচেষ্টা এ কাজে নিয়োজিত হবে। আমাদের দুস্তর পথ। এ পথ আমাদের অতিক্রম করতে হবে।’
বিস্ময়করভাবে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটেও বঙ্গবন্ধুর এই অমর উক্তি যেন সমভাবে প্রাসঙ্গিক। পথ আমাদের দুস্তর, কিন্তু সামনে আছে বিপুল সম্ভাবনা।
তথ্যসূত্র:
১। অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, বঙ্গবন্ধু বাঙালি ও বাংলাদেশ, মেরিট ফেয়ার প্রকাশন, ২০১৭, পৃঃ ৩০
২। মাহবুবুল আলম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতি ও জীবনধারা (১৯২০-১৯৭৫), জনতা প্রকাশ, ২০১৩, পৃঃ ৪৯০
৩। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃঃ র
৪। রওনক জাহান, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারা, প্রথম আলো, ১৫ জুলাই ২০১৯