ডাঃ তাবাস্সুম উর্মি রোজা
জীবনের একটা পর্যায়ে অনেকের মাথাতেই বিভিন্ন উদ্বেগজনক চিন্তা ভিড় করে আসে। এ কথা অনেকেরই জানা, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের মাঝেমধ্যেই মনে হত বারান্দা থেকে ঝাঁপ দেবেন কিংবা ছুটে আসা ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেবেন।
৭০০০ জন শিক্ষার্থীর উপরে একটি বিশ্বজনীন সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ৯০% লোকের মধ্যে এই ধরণের প্রবণতা দেখা গেছে। আসলে কোনও উঁচু জায়গা থেকে লাফ দেওয়ার প্রবণতা এতটাই বেশি দেখা যায়, যে সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এর নিজস্ব একটি টার্ম রয়েছে- হাই প্লেস ফেনোমেনা। মনোবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, আমাদের মস্তিস্কে একটি ‘আইডিয়া জেনারেটর’ রয়েছে। যা সাধারণ পরিস্থিতিতে কোনও সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করে। যদিও এটি কোনও প্রমাণিত তত্ত্ব নয়, তবু এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে, যেমন স্ট্রেসের ক্ষেত্রে, মাথায় উদ্বেগজনক চিন্তা বেশি ভিড় করে।
এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি যে, এমন চিন্তা কোথা থেকে আসে। তবে মনোবিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে নিশ্চিত যে, এই ধরনের ভাবনাগুলি যতক্ষণ না ক্ষতিকারক রূপ ধারণ করছে তত ক্ষণ তাকে নিরীহ ভাবনা বলা যায়। যেমন, কাউকে আঘাত করা বা হত্যা করার অযাচিত ভাবনা মনে ভিড় করলেই তা কাউকে অপরাধী বা খুনি করে তোলে না।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অধিকাংশ লোকের মনে যখন এই ধরনের উদ্বেগজনক ভাবনা ভিড় করতে শুরু করে তখন অনেকেই তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না। অনেকে এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু কিছু মানুষ তা পারেন না। তাদের মধ্যে এই ধরনের ভাবনাচিন্তা বন্ধ তো করাই যায় না, বরং তা ক্রমশ মানসিক অসুস্থতায় পরিণত হয়। এই অসুখের নাম অবসেসিভ- কমপালসিভ ডিসঅর্ডার।
অনেকে প্রশ্ন করে অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিসঅর্ডার কি আচরণগত সমস্যা? OCD-কে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘আচরণগত সমস্যা’ হিসাবে ভাবা হয়। খুব হাল্কা ভাবে বললে এই কথা সত্যি। কিন্তু এই রোগ যদি জটিল আকার ধারণ করে তাহলে তা একটি জীবন সম্পূর্ণ নষ্ট করে দিতে পারে। অনেক সময়ে এই রোগের প্রভাব আচার আচরণেও তা পরিলক্ষিত হয়, যেমন কোনও জিনিস নিয়ে এক কাজ করা কিংবা বারবার হাত ধোয়া ইত্যাদি হল এই রোগের লক্ষণ।
যাদের মনে নানা উদ্বেগজনক ভাবনা ভিড় করে আসে এমন মানুষজনের মধ্যে প্রায় ২-৩% লোক জীবনের কোনও না কোনও সময় অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিসঅর্ডার অসুখে আক্রান্ত হয়। এই ধরনের উদ্বেগজনক ভাবনা অনেককেই OCD -র দিকে ঠেলে দেয়, কিন্তু তার পরেও তাদের সকলকে OCD প্রভাবিত করে না কেন? মনোবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে, এটি যেভাবে লোকেরা ‘চিন্তাভাবনা’ করে বা যদি কেউ ছেলেবেলায় কোনও উদ্বেগজনক ভাবনাকে জীবনের অঙ্গ হিসেবে ভাবতে শুরু করে, তখন সেই নিরীহ উদ্বেগজনক ভাবনাগুলিই বয়সের সাথে বাড়তে বাড়তে একটা সময়ে OCD-তে পরিণত হয়। উদাহরণ, যদি কেউ পারফেকশনিস্ট হয় তার ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ হতে পারে যে সে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করে তা সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করবে। যে কোনও অসম্পূর্ণ বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ জিনিস তাকে বিব্রত করতে পারে, তাকে উদ্বিগ্ন করতে পারে।
সামগ্রিকভাবে সমস্ত OCD-তে আক্রান্তরা এমন কিছু জিনিসে বিশ্বাস করেন যার অস্তিত্ব নেই। যার জন্য মূলত দায়ী হয় কোনও জিনিসের প্রতি তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ববোধ। যেমন, তারা প্রায়ই বিশ্বাস করে যে তারা কোনও ঘটনা বা তার ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে। এবং সেই কারণে অবাঞ্ছিত পরিণতির জন্য তারা নিজেকে দায়ী মনে করতে শুরু করে।
কেউ OCD-তে ভুগলে প্রাথমিকভাবে তার এই ধরনের উদ্বেগজনক চিন্তাভাবনাকে মন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে বহু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে এই প্রচেষ্টা খুবই কঠিন, কারণ পরবর্তী সময়ে সেই ভাবনাগুলি আরও জোরালো ভাবে ফিরে আসতে পারে।
চিকিৎসাপদ্ধতিঃ
এই কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, কয়েক শতক আগে এই ধরনের উদ্বেগজনক চিন্তাভাবনার অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর থেকে এর চিকিৎসা নিয়েও গবেষণা শুরু হয়েছে। অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্টস-সহ বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতি 40% ক্ষেত্রে OCD আক্রান্তদের লক্ষণগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে উপশম করে। কিছু ক্ষেত্রে আবার মনোবিজ্ঞানীরা ওষুধের পরিবর্তে OCD নিরাময়ের জন্য কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT) প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। যে অস্তিত্বহীন বস্তু বা ভীতির প্রতি ভুক্তভোগীর বিশ্বাস রয়েছে মনোবিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন সেগুলি চিহ্নিত করার এবং তারপরে আক্ষরিক অর্থে তাদের ‘অন্যভাবে চিন্তাভাবনা ’ করানোর চেষ্টা করছে।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় যে, এই ধরনের অযাচিত চিন্তাভাবনা হল ওয়াসওয়াস নামক এক শয়তানের ফিসফিসানি এবং সম্ভবত এই ধরনের মানসিক সমস্যার পিছনে এই শয়তানের ভূমিকা রয়েছে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে কুরআন শরিফে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, এই অদৃশ্য শয়তানের হাত থেকে বাঁচতে আমাদের আল্লাহের কাছে আশ্রয় নেওয়া উচিত। কুরআনে উল্লেখ রয়েছে: “আর যদি শয়তান- এর কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে, তবে আল্লাহর স্মরণ লইবে, তিনি তো সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ” (৪১:৩৬) এবং (৭: ২০০)
এই আয়াতগুলিকে আরও খানিকটা ব্যাখ্যা করলে বোঝা যাবে, এখানে সম্ভবত বলা হয়েছে একজন যেমন সশস্ত্র যোদ্ধার কাছে নিরাপত্তা খোঁজেন বা ডাক্তারের কাছে ওষুধের খোঁজে যান ঠিক তেমনই এই বিপদে আল্লাহের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করাই যোগ্যতম কাজ। আমাদের সব বিপদ থেকে শুধু এবং শুধুমাত্র আল্লাহ-ই বাঁচাতে পারেন।