সেজান মাহমুদ
লেখক পরিচিতি: কথাশিল্পী, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার, পেশায় চিকিৎসা বিজ্ঞানী। ইউনিভার্সিটি অব সেন্টার ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনে সহকারী ডিন ও প্রফেসর হিসাবে কর্মরত।
ছোটবেলায় আমেরিকান লেখক মার্ক টোয়েনের একটা ছোটগল্প পড়েছিলাম- দ্য মিলিয়ন পাউন্ড ব্যাঙ্ক নোট। এই গল্প নিয়ে বিটিভি একটা নাটকও করেছিল- যতোদূর মনে পড়ে, নাম ছিল ‘বাজি’। সিনেমাও হয়েছে কয়েকটা। প্রোটাগনিস্ট বা নায়ক হেনরি এডামস দরিদ্র এবং ক্ষুধার্ত। দুই বৃটিশ ধনকুবের ভাই বাজি ধ’রে একটি খামে এক মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং নোট দেয় কিছু না জানিয়ে। এক ভাই মনে করেন এই নোট এতো বিশাল, যা দিয়ে সে আরো বড় ও ধনী হবে। অন্য ভাই মনে করেন যে এই হতদরিদ্র চেহারায় এতো বড় নোট নিয়ে গেলে লোকে বিশ্বাস করবে না, ঠগ বাটপার ভাববে, নিজেও রেকলেস হয়ে যাবে এবং অকেজো নোট নিয়ে শেষে জেলের ভাত খাবে।
হেনরি কিছুই জানে না। পরে খাম খুলে দেখে বিশাল নোট। লেখা আছে অক্ষত অবস্থায় ফেরত দিতে হবে। সে প্রথমে খাবারের দোকানে যায়। বিল দিতে এতোবড় নোট দিলে মালিক বলে আমাদের তো ভাঙতি নেয়; আপনি একমাস এমনিই খাবেন। পরে দিলেও চলবে। এভাবে স্যুটের দোকানে গেলে দরজি বিনা পয়সায় জামাকাপড় দিয়ে বলে আপনার মতো খদ্দের যখন খুশি দাম দেবেন। নোট দেখিয়ে ব্যবসার ভাগিদার হন-হেনরি ধীরে ধীরে নোট না ভাঙিয়েই ধনী, প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
ভিক্টোরিয়ান সাহিত্যের রিয়েলিজম, প্র্যাকটিক্যালিটি, তেলা মাথায় তেল দেয়া, এমনকি মানব চরিত্রের ধনাত্মক দিক তুলে আনা গল্পের মূল কথা কেউ কেউ বলবেন। নানানজন নানান বিশ্লেষণ দেবেন। যদিও এ যুগে আমরা বাস্তবে দেখেছি এরকম সুযোগ পেয়ে নোট ফেরত দেয়া তো দূরের কথা, মেরে দিয়ে আসল মালিককে উৎখাত করেছে কিম্বা একজন এক মিলিয়ন ক্যাসিনোতে জিতে এক রাতেই আবার শেষ করে ফেলেছে।
আমার কাছে বরং এই গল্পের অন্য আরেকটি ব্যাখ্যা ভাল মনে হয়। তা হলো মানুষ চেনার উপায়। একজন কে সব দিয়ে দিলে সে কেমন আচরণ করে তা দিয়ে বিচার। যেমন, একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে দামী কী? তার নিজের মন ও নিজের জীবন। কাউকে সেই মনের সবটুকু নি:স্ব করে দিতে পারলে অন্যজন তা জেনে কীভাবে আচরণ করে সেটা দিয়ে সেই অন্য মানুষটাকে চেনা যায়। সব পেয়েছি জানার পরে সঠিক মূল্য দিতে সবাই পারে না। পাওয়াটা নিশ্চিত জানলে বেশিরভাগ মানুষই মর্ম হারিয়ে ফেলে। খুব কম মানুষ তার মর্ম বুঝে সেই দামি জিনিসটি দিয়ে নিজে আরো দামি হয়ে ওঠে। নি:স্ব করে দেয়া প্রেম সেরকম মিলিয়ন পাউন্ড নোটের মতো। তাকে গ্রহণ করতে না পারলেও অপব্যবহার বা অবহেলা করা উচিত না। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই সেই বাজিতে হেরে যায়।
প্রেম বলুন, বন্ধুত্ব বলুন, সামাজিক সম্পর্ক বলুন সবখানেই যারা আপনার সব-দিয়ে-দেয়ার মূল্য বুঝতে পারবে তাঁরাই প্রকৃত বন্ধু, প্রেমিক বা প্রেমিকা বা সুহৃদ। সেটাই জীবনের মিলিয়ন পাউন্ড নোট যা আঁকরে ধরে রাখতে হয়, হেলায় হারাতে হয় না!
স্কেচ: সাদিবা নূসরাত নূর