এবিএম সালেহ উদ্দীন
নব্বইয়ের শেষ দিকে নিউইয়র্ক চলে আসার পর দেশের যে সব কবি-সাহিত্যিকদের সাথে আমার যোগাযোগ হতো তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ ছিল বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার সাথে। ছফাভাই’র সাথে আমার সম্পর্ক কতটা গভীর ও আত্মিক ছিল তার কোন পরিমাপ করা সম্ভব নয়। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হতো। এছাড়া ছফা ভাই’র নিকট থেকে কয়েকটি চিঠি ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। একদিন তিনি ফোন করে খুউব উচ্ছ্বসিতভাবে জানালেন বাংলাদেশে এক কিশোরোত্তীর্ণ শ্রেষ্ঠ কবির আবির্ভাব ঘটেছে। আমি তের হাজার মাইল দূর থেকে অন্তরচোখে দেখতে পেলাম ছফাভাই’র চোখে-মুখে খুশির ঝলক। যেমন তাঁর মাঝে দেখা যেতো মানুষের মেধা ও মননের সৌরভানন্দে ছফাভাই কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠতেন। তরুণদের নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। অন্যের সুন্দরতর সাফল্য দেখলে আনন্দে নেচে উঠতেন তিনি।
কয়েক মিনিট কথা বলার পরই আবার ¶ীণতর কণ্ঠে জানালেন একটি বিষাদবার্তা। আর তা হচ্ছে প্রতিভাবান কিশোর কবি ইবন ক্যান্সারে আক্রান্ত! তিনি বললেন, যদি সুস্থভাবে ছেলেটি বেঁচে থাকতে পারে তাহলে কাব্যজগতের ইতিহাসে এক বিরাট অবদান রাখতে পারবে। ছফাভাই’র মুক্তোখচিত কথামালার পুলকসম্ভারের মাঝে হঠাৎ যেন বজ্রাঘাত! আমি হতভম্ব। স্তম্ভিত!
সত্যিই মানুষের মনের গহীনের অনুভব ও উপলব্ধির পরিস্ফ‚টন ঘটে একেক সময় একেক রকম। যে কোন সময় তার পরিবর্তনের বহি:প্রকাশ ঘটে। ইহাই পৃথিবী ও প্রকৃতিমাতার চিরায়ত নিয়ম। পৃথিবীর মোহময়তার মধ্যেও অবচেতনে কখন কার মাঝে বিচ্ছেদের ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠবে (!) সেটি আমাদের উপলব্ধি ও অনুভবের মধ্যে থাকতে হবে।
২০০০ সালের অমর একুশে বইমেলায় ইবনের একটি কবিতার বই “অবিশ্বস্ত পৃথিবী আমার” অত:পর একই বছর অক্টোবর মাসে “যথাযোগ্য বিষাদ যথাযোগ্য আগুন” নামে দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। অত:পর পরিপক্ক যৌবনকালে ‘উপমানব’ এবং মৃত্যুর পর অপ্রকাশিত কবিতাবলী নিয়ে প্রকাশত হয় “বাংলাদেশের মৃত্যুতে” কাব্যগ্রন্থ। সত্যিকার অর্থে ইবনের চারটি বই বাংলা সাহিত্যের কবিতা সাম্রাজ্যে একটি ভাল স্থান গড়ে নিতে পারে।
বলাবাহুল্য, তখন ইবন নবম শ্রেণীর ছাত্র। অসাধারণ মেধা এবং কবিতার প্রতি সম্মোহন না থাকলে কি তা সম্ভব হতো? ছফা ভাই’র সাথে কথার কিছু দিন পর ইবনের মা সুরাইয়া হক নিউইয়র্ক আগমন করেন।
তারপর থেকেই মূলত: এই পরিবারের সংগে আমার সম্পর্ক।
১৯৮৪ সালের ২৬ ফেব্রæয়ারি ইবনের জন্ম মাদারীপুর জেলায়। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ইবন ছিলেন দ্বিতীয়। পিতা খবিরুল হক ও মাতা সুরাইয়া হক। শৈশব ও কৈশোর কাটে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায়। শিশুকাল থেকেই ইবন ছিলেন বেশ চঞ্চল, ডানপিটে ও দূরন্ত। অসাধারণ মেধা, মনন¶মতা ও সৃষ্টিশীলতার প্রতি ছিল ইবনের প্রবল ঝোঁক। খেলাধুলার পাশাপাশি ইবন সব সময় লাইব্রেরিতে সময় কাটিয়ে বই পড়তে পছন্দ করতেন। বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকাই তার হবি।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের আগেই জাতীয় কবিতা উৎসবে ¯^রচিত কবিতা পাঠ করে ইবন উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অত:পর বিষ্ময়করভাবে ইবনের প্রতিভার পরিস্ফ‚টন ঘটতে থাকে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালে। দূরারোগ্য ব্যধিতে ১৯৪৭ সালে অকাল প্রয়াণ ঘটে। বেঁচেছিলেন মাত্র একুশ বছর। কিন্তু সুকান্ত’র কবিতাসমগ্র বাংলা সাহিত্যের সম্পদ হয়ে আছে। যা সর্বকালের জন্য অ¶য় ও অনির্বাণ।
বাপ্পী শাহরিয়ার নামে আরেকজন তরুণ কবি ও ছড়াকার অকালে মৃত্যুবরণ করেন। এরশাদ সরকারের এক প্রতাপশালী মন্ত্রীপুত্রের গাড়িচাপায় মারাত্মক আহত হয়েছিলেন তিনি। আহমদ ছফা বাপ্পী’র চিকিৎসার সাহায্যের জন্য কলম ধরেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবনের যবনিকা টেনে প্রতিভান তরুণ কবি চিরকালের তরে হারিয়ে যান।
তেমনই ভারতবর্ষের আরেক ¶ণজন্মা কবি ও বুদ্ধিজীবী ও ইয়ং বেঙ্গল নেতা অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও বেঁচেছিলেন মাত্র বাইশ বছর (১৮০৯-১৮৩১)। কিন্তু তাঁর দর্শন ও মানব কল্যাণধর্মী সাহিত্যাদর্শ অনির্বাণ হয়ে আছে। তিনি সর্ব প্রকার কুসংস্কার সামাজিক অব¶য় ও সংকীর্ণ কপটাচার ও অমানবিক সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন।
তারও আগে ইংরেজ কবি ফার্সি বিসী শেলী বেঁচেছিলেন মাত্র আটাশ বছর। তিনি জাহাজ ডুবিতে মারা গিয়েছিলেন। পকেটে পুড়ে থাকা কবিতাই তাকে সনাক্ত করেছিল। যাই লিখেছেন সবই অমর কবিতা। আড়াইশ’ বছরেও তার কবিতার আবেদন শেষ হয়নি। তেমনই ইবনের বয়সও বেশি ছিল না। অসুখ-বিসুখ যন্ত্রণাদিগ্ধ কষ্টবোধ সবই মিলিয়ে বেঁচেছিলেন (১৯৮৪-২০১১) ছাব্বিশ বছর। অপরিণত বয়সে অকালে ঝরে গিয়ে অবিনশ্বরের উদ্দেশ্যে মহাপ্রস্থান!
একজন প্রকৃত কবি হতে হলে বেশি বই কিংবা কবিতা থাকা জরুরি নয়। বোধসম্পন্ন মানুষের অন্তরস্পর্শী কাব্যদর্শনই মূলত কবি ও কবিতার আতœপরিচয়।
সেই অর্থে ইবনের কাব্যসম্ভারের বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে কবিতার মূখ্যতম দাবীতে তিনি ¯^ার্থক এবং সেটি অনেকাংশেই তার কবিতায় ফুটে উঠেছে । মৃত্যুর আগে এবং পরে মোট চারটি কবিতার বই রেখেই তিনি স্মরণীয় ও অনির্বাণ হয়ে আছেন। আহমদ ছফার কথার সুত্রধরে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, দূরারোগ্য মরণব্যাধিতে ইবনের অকাল প্রয়াণ না ঘটলে কাব্যজগতে তিনি নি:সন্দেহে একটি বিপ্লব ঘটাতে পারতেন।
জীবদ্দশায় ইবন সম্পর্কে বিখ্যাত কবি ও লেখকদের বেশ কিছু প্রেরণা উদ্দীপক মন্তব্য বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান, আহমদ ছফা, আসাদ চৌধুরী, সমুদ্র গুপ্ত, মুহাম্মদ নুরুল হুদাসহ বিখ্যাত বুদ্বিজীবীগণ তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস ও ইতিবাচক মন্তব্য রাখেন।
ইবনের মা সুরাইয়া হক এবং বড় বোন সোনিয়া হকের সুবাদে ইবনের সাথে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছিল। এমন তীক্ষèবুদ্ধিদীপ্ত যুবকের কথায় যেসব বড় বড় আকাক্সখার ¯^প্নীল ভবিষ্যতের কথা শুনে আমি বিস্মিত হতাম। তার অকালসমৃত্যু সেসব ¯^প্নসম্ভারকে চুরমার করে দিয়ে গেল !
প্রকৃত কবি সর্বদাই আলোকিত মানুষ। তিনি চ¶ুষ্মান। আগামী দিনের ¯^প্নদ্রষ্টা। সত্যের নিরন্তর অšে^ষণই কবির প্রধান কাজ। কবিতায় প্রেম-বিরহ, দ্রোহ, মানবকল্যাণসহ সর্বপ্রকার অব¶য় ও মানবতা বিরোধী প্রতিবাদী চেতনাই কবিকে অমর ও স্মরণীয় করে রাখে। একজন সত্যিকার কবির মাঝে মানবিক ও প্রাকৃতিক উভয় দিকের সৌম্য দর্শন থাকতে হয়। আমাদের ¶ণজন্মা কবি ইবনের মাঝে ছিল সেরকম বিষ্ময়কর কাব্যপ্রতিভা।
অকালে হারিয়ে যাওয়া কবি ইবনের পরিবার বর্তমানে কানাডায় বসবাসরত। তারা উদ্যোগ নিলে বাংলা সাহিত্য ভূবনে ইবনের কবিতার সামগ্রিক সজীবতা অক্ষুন্ন থাকতে পারে।
সাহিত্যের মোহময়তায় ইবনের কবিতার ব্যপ্তি চিরন্তন। তার কবিতাসমূহ বাংলা সাহিত্যের আকাশকে চির উজ্জ্বল করে রাখবে বলে আমার একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক